মাটিতে রেখে সন্তুর বাজাবেন না, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির অনুষ্ঠান প্রত্যাখ্যান করেন শিবকুমার শর্মা

  • প্রায় সত্তর বাহাত্তরটি তারের একটি বাদ্যযন্ত্র
  • জম্বুর বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত উমা দত্ত শর্মা যখন বাদ্যযন্ত্রটি প্রথম দেখতে পান
  • বহু প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন পন্ডিত শিব কুমার শর্মা
  • কান পর্যন্ত ভেসে এলেই পবিত্রতার অনুভূতি ছড়িয়ে পরে আমাদের অন্তরে

Asianet News Bangla | Published : Jan 14, 2021 2:46 PM IST

তপন মল্লিক, কলকাতা- প্রায় সত্তর বাহাত্তরটি তারের একটি বাদ্যযন্ত্র। কয়েক দশক আগে পর্যন্ত সেটি আকটি অঞ্চলিক বাদ্যযন্ত্র হিসাবেই পরিচিত ছিল। বিগত শতকের গোড়ার দিকে বাদ্যযন্ত্রটির নাম্পকরণ হয় সন্তুর। তবে পুরাকালে  এটিকে শততন্ত্রী বীণা নামেই অবিহিত করা হত। হয়ত প্রায় শত তারের সমাহার থাকায় অমন নামে অভিহিত হত। সন্তুরকে আমরা জম্মু ও কাশ্মীরের বাদ্যযন্ত্র বলে জানলেও অনেকেই বলেন এটি মূলত পার্শিয়া থেকে এসেছে। আনুমানিক চার হাজার বছর আগে মেসোপটেমিয়ায় ব্যবহৃত এক ধরনের তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র থেকেই সন্তুরের উৎপত্তি হয়েছে বলে ধারনা করা হয়।   

একটা সময় পর্যন্ত তো সন্তুর কেবলমাত্র কাশ্মীর অঞ্চলের সূফী শিল্পীরাই ব্যবহার করতেন। শুধুমাত্র সুফিয়ানা মওসিকি নামে এক বিশেষ ধরনের গায়কিতে যন্ত্রটি ব্যবহৃত হত। আজ যে সন্তুর শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রের মর্যাদা লাভ করে তা কেবল্মাত্র একজন শিল্পীর একক প্রচেষ্ঠায়। তবে তাঁর আগে জম্বুর বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পণ্ডিত উমা দত্ত শর্মা যখন বাদ্যযন্ত্রটি প্রথম দেখতে পান তখনই তিনি সন্তুরের বিপুল সম্ভাবনা বুঝতে পেরেছিলেন। এরপরই তিনি সাধারণের মধ্যে সন্তুরকে পরিচিত করার তাগিদ অনুভব করেন। তাঁর সেই তাগিদের দায় কাধে তুলে নিয়েছিলেন ছেলে শিবকুমার শর্মা। এরপর বাকিটা তো ইতিহাস!

শিল্পী তো তিনি যিনি সঙ্গীতের ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লেখেন। প্রচলিত সঙ্গীতের বাস্তবতা, ধ্যান ধারণা সম্পূর্ণ পালটে দিয়ে অন্য এক বাস্তবতার জন্ম দেন, তাতে অন্য মাত্রা যোগ করেন। সন্তুরকে সুফিয়ানা বাদ্যযন্ত্র থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পর্যায়ে তুলে এনেছেন। আঞ্চলিকাতার গন্ডি পেরিয়ে সন্তুর তাঁর একার হাত ধরেই আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে। সন্তুর ঘিরে তিনি শাত্রীয় পুনর্লিখন করতে বাধ্য করেছেন। এই এতকিছু প্রতিভার সাক্ষর রেখেছেন পন্ডিত শিব কুমার শর্মা।  মনে হয় তাঁর রচিত পথেই পরবর্তী হাজার বছর ধরে পথ হাটবে সন্তুরের সুর।  

শিবকুমার শর্মার সন্তুরের সুর কান পর্যন্ত ভেসে এলেই পবিত্রতার অনুভূতি ছড়িয়ে পরে আমাদের অন্তরে। একমাত্র শুদ্ধ সঙ্গীতই পারে এই অবস্থা তৈরি করতে। শিবকুমার শর্মার সন্তুরের সুরের অনুরণন কেবল মনে নয়, ছড়িয়ে যায় অস্তিত্বের গভীরে। তিনি সন্তুরের মৃদু ঝঙ্কারে যে আবহ সৃষ্টি করেন তা আমাদের এমনই এক প্রকৃতির মধ্যে নিয়ে যায় সেখানে নদী বয়ে চলার শব্দ, পাহাড়ের জেগে ওঠার ভঙ্গিমা, অরণ্যের গভীর থেকে গভীরতর স্তব্ধতা আমরা টের পাই। আমরা অনুপ্রাণিত হই, আমাদের একই সঙ্গে বিপন্ন করে বিস্মিত করে। 

আলোকোজ্জ্বল প্রেক্ষাগৃহ, শ্রোতারা মগ্ন সুরের আবহে আর মঞ্চে উপবিষ্ট মানুষটির মাথা ঝুঁকে যেন সন্তুরের তারগুলিকে স্পর্ষ করে ফেলেছে। তিনি চোখ বন্ধ করে ধাতব দুটি কাঠি আপন মনের ছন্দে ঠুকে চলেছেন অতগুলি তারের মধ্যে থেকে বেছে বেছে। তাতেই বয়ে আসছে হিমেল হাওয়া, নদীর কলকল, অরণ্যের নিঃশ্বাস। না কোনও হাততালি হবে না। তিনি বলেছেন অন্তরের সব রকম ভাললাগা মুহুর্তগুলি মন দিয়ে অনুভব করুন। হাততালি দিয়ে আমার মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাবেন না। আমাকে আরও ধ্যানস্থ হতে দিন। আসলে তিনি সন্তুর বাজান না, তথাগতর মতো ধ্যানে স্থবির হয়ে যান। সেই ধ্যানস্থ মূর্তির থেকেই ভেসে আসে বিমূর্ত সঙ্গীত। 

আজ ভারতীয় সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী পন্ডিত শিবকুমার শর্মার জন্মদিন। যিনি মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির অনুষ্ঠান মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করেন। মুখ্যমন্ত্রী বকশি গুলাম মহম্মদের হুমকির তোয়াক্কা করেন না। মাটিতে সন্তুর রেখে বাজাতে অলেছিলেন কিন্তু অনমনীয় তরুণ শিল্পী শিবকুমার সেই অনুষ্ঠানে আপত্তি জানিয়েছিলেন।

পাহাড়ে জন্ম বলেই তার সুরে পাহাড়ি রাগের রেশ থেকেই যায়। পাহাড়ের গা বেয়ে নামা নদী। উপরে নীল আকাশ। সবুজ সমতলের মধ্যে বেড়ে ওঠা বলেই তিনি তাঁর বাজনায় এক লহমায় তুলে আনেন পাহাড়-নদী-মেঘ-ঝরনার শব্দকে। তিনি বলেন ওই সুরের উপত্যকাই তাঁর দেশ। একথা বলেই তাঁর পালটা প্রশ্ন এই সুরের উপত্যকাকে কারা মৃত্যু উপত্যকা বানালো? তিনি নিজেই উত্তর দেন, পৃথিবী তাদের ক্ষমা করবে না।  

স্বর-শ্রুতি-নাদ থেকে জীবনের সালোকসংশ্লেষ। সন্তুরের সুরেলা বন্দিশে প্রকৃতির এক-একটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। তিনিই পারেন ডোভার লেন থেকে শব্দোত্তর তরঙ্গের মাধ্যমে ভূস্বর্গে পৌঁছে দিতে। সেই ভূসর্গে এখন শুধুই আতর্নাদ। তাঁর সন্তুরেও কি চাপা আর্তনাদের সুর শোনা যাচ্ছে? তেমনই তো হওয়ার কথা। কারণ তাঁর মুখেই শোনা, ...এক  পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে গোলাগুলি। পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে রক্ত। সবুজ উপত্যকায় বারুদের গন্ধ। চাপ চাপ রক্ত। ভারী বুটের শব্দ। কারা যেন হিংসায় উন্মত্ত হয়ে প্রকৃতির স্পন্দনকে থামিয়ে দিতে চাইছে। কাপড়ে মুখ ঢেকে পাহাড়ের কোল থেকে ছুটে আসছে হাতে একে-৪৭,  গ্রেনেড নিয়ে। তারা জঙ্গি?  তারা সেনা? সবাই সবাইকে হত্যা করছে। শিল্পীও বাধ্য হয়ে আজ এসব কথা বলছেন তিনি। তবু তাঁর বাজনা থেমে নেই। কিন্তু তাঁর সন্তুরের সুর থেকে যেন ভেসে আসছে এই প্রশ্ন, জম্মু-কাশ্মীর মানেই কেন মৃত্যু, আতঙ্ক?

Share this article
click me!