পুজো মানেই নিশ্ছিদ্র অবসর। কোনো টানাপোড়েন নেই। যখন খুশি খেতে যাওয়া যখন খুশি ঘুমোতে যাওয়া। এশিয়ানেটের প্রতিনিধি ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়ের সাথে টেলিফোনিক পুজোর আড্ডায় কলকাতার অন্যতম প্রাক্তন মেয়র বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য।
মহালয়ার আগের দিন । ঘড়ির কাঁটাতে সময় বিকেল চারটে। ফোনে নম্বরটা ডায়াল করে ওপারের মানুষটির ফোন তোলার অপেক্ষা করছি । কি বলবো তা শেষ বারের মতো আর একবার ঝালিয়ে নিচ্ছি মাথার মধ্যে। হঠাৎ ওপাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠস্বর , "হ্যালো ? কে বলছেন ?" . গলা শুনেই বুঝলাম ইনিই সেই মানুষ যার আমি ইন্টারভিউ নিতে চাই। তাই প্রথমে সৌজন্যমূলক কিছু অভিবাদন জানিয়ে ,দিলাম নিজের পরিচয়, ...তারপর আর কোনো ভুমিকা সূচক কথা না বলেই সটান বললাম , " আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই "। এতো তাড়াতাড়ি এভাবে কাজের কথা বলব সেটা উনি ভাবেননি। তাই আচমকা এমন প্রস্তাবের ফলস্বরূপ পরের কয়েকটা মুহূর্ত খানিকটা চুপ করেই থাকলেন তিনি। নিস্তব্ধতা ভেঙে আমিই বললাম , মূলত আপনার পুজো কেমন কাটে সেই বিষয়েই কথা বলব ইন্টারভিউতে । এই কথাটা শুনেই ওপাশ থেকে এলো হো-হো করে হাসির একটা রব। কলকাতার প্রাক্তন মেয়র হবার সুবাদে এর আগেও বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সেগুলো বেশিরভাগই ছিল মূলত রাজনৈতিক ইন্টারভিউ। পুজো কেমন কাটান এই বিষয় নিয়ে কথা বলার অন্যায় আবদার বোধহয় আমিই প্রথম করলাম ওনার সামনে । তাই এমন হাসির রব। প্রায় ৫ সেকেন্ডের প্রশস্ত হাসির পর তিনি হাসি থামিয়ে বললেন ,"এখন তো কোর্টে আছি তাই হবে না, কিন্তু রাত ৮.৩০ টার পর ফাঁকা থাকব,তখন হতে পারে।" কিন্তু একটা অনাগত কাজ পরে যাওয়ায় আর হল না সেদিনের ইন্টারভিউ।
দোষটা ছিল আমারই । তাই প্রবল গিল্টি নিয়ে কি করে দোষ ঢাকবো,ভাবছি। এমন সময় মনে হলো একটা এসএমএসই করেই দেখি না । যা যা মনের মধ্যে চলছিল তা সবকিছু শব্দে বেঁধে লিখলাম ৭ লাইনের একটা এপোলোজি এসএমএস। পাঠালাম ওনাকে। কিন্তু কোনও রিপ্লাই এলো না দেখে ভাবলাম বোধহয় উনি খুব রেগেই আছেন আমার উপর। পরের দিন সকাল ১১ তা নাগাদ আবার করলাম কল। ফোনটা তুলতেই উনি কিছু বলার আগেই আমি বললাম " সরি এবাউট ইয়েস্টারডে। একটা এসএমএস পাঠিয়েছিলাম। দেখেছেন ?" উনি উত্তর দিলেন ," হ্যাঁ দেখেছি , ঠিক আছে , কোনো ব্যাপার না , বিকাল চারটেতে কল করুন " ...
কর্মসূত্রে প্রতিদিনই অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে কথা বলতে হয় আমাকে। কিন্তু সাংবাদিকদের সঙ্গে এমন হৃদ্যতাপূর্ণ ব্যবহার এর আগে কোনোদিনই কাউকে করতে দেখিনি। ৪ টের সময় করেছিলাম আবার কল কিন্তু ৩ -৪ বার রিং হওয়ার পর কেটে যায় সেই কল । অবশেষে বিকাল ৫ টার সময় কলে পাওয়া গেল তাকে ।মনে আছে কল তুলেই তিনি বললেন , " হ্যাঁ বলুন , এখুনি কি নেবেন ইন্টারভিউ ?" আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম " হ্যাঁ স্যার আপনি ফাঁকা থাকলে এখুনি হতে পারে।" ব্যাস তারপর শুরু হলো ইন্টারভিউ। শোনালেন তার ছোটবেলার পুজোতে মেলা দেখতে যাবার গল্প। এশিয়ানেটের প্রতিনিধি ভাস্বতী মুখোপাধ্যায়ের সাথে টেলিফোনিক পুজোর আড্ডায় কলকাতার অন্যতম প্রাক্তন মেয়র বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য।
প্রশ্ন- পুজোর কটা দিন কি রাজনীতিকে ভুলে থাকা যায়?
বিকাশ ভট্টাচার্য- আমি রাজনীতিকে ভুলে থাকতে পারি না কারণ প্রত্যেকটা বিষয়ের সঙ্গে রাজনীতি জড়িয়ে আছে। পুজোটাও এখন কোথাও একটা রাজনৈতিক কার্যক্রম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেজন্য পুজো হচ্ছে বলেই যে সব ভুলে থাকা যাবে সেটা মনে হয় না।পারবোনা , আমি পারিওনা কারণ সবকিছুর মধ্যে কারণ খুঁজি তো। আর সেই কারণ তা খুঁজতে গেলে বা সামাজিক বিশ্লেষণ করতে গেলে তো রাজনীতি এসেই পরে।
প্রশ্ন- পুজোর সময় কখনও ঘুরতে গিয়েছেন?
বিকাশ ভট্টাচার্য- আগে খুবই যেতাম। ইদানিং যাওয়া হয় না। পুজোর পরে যাই। এবারেও যেমন পুজোর পরে যাবো যেমন ধরুন পরিকল্পনা আছে ৬ তারিখে বেরোব।
প্রশ্ন -এবারে কোথায় যাচ্ছেন বেড়াতে ?
বিকাশ ভট্টাচার্য- এবার যাচ্ছি মুক্তেশ্বর ,নৈনিতাল ,আলমোড়া ঐদিকটা ঘুরতে যাবো।
প্রশ্ন- এমন একটা পুজো যেখানে নিশ্চিন্তে ভুরিভোজ আর ঘুম দিয়েই দিন কেটে গিয়েছে
বিকাশ ভট্টাচার্য- হ্যাঁ , বিগত ১০ বছরের পুজো আমার এমনি কেটেছে। পুজোর কদিন আসা মানেই কেউ বিরক্ত করতে আসবে না। নিজের মতো করে বই টই পড়া। কিন্তু মাঝে মাঝে খুব বিরক্তের উদপাদন হয় যখন চারদিক থেকে উচ্চ স্বরে মাইক বাজে। যাতে সুর ,ছন্দ ,তাল কিছুই পাওয়া যায় না তখন একটু বিরক্তির উদপাদন হয়। এই আর কি।
প্রশ্ন- পুজোর মণ্ডপে পাঞ্জাবি গান। কোথাও কি মনে হয় আপনার যে বাঙালিরা তাদের শিকড় থেকে সরে যাচ্ছে?
বিকাশ ভট্টাচার্য- হ্যাঁ অবশ্যই। বাঙালিরা তাদের শিকড় থেকে সরে গেছে তার প্রমান হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গে এখন হনুমান পুজো হয়, গণেশ পুজো হয় ,কার্তিক পুজো হয় , ভারতমাতা পুজো হয়। এইসব তো আমরা আমাদের কৈশোর বা যৌবন কালে কোনোদিন দেখিইনি। আমাদের সময় হতো একমাত্র শারদীয়া দুর্গাপুজো ,বাড়িতে বাড়িতে লক্ষী পুজো ,আর স্কুলে যখন পড়তাম তখন সরস্বতী পুজো। এগুলো ছিল বাঙালির উৎসবের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সেটা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এবং আরও বেদনাদায়ক দেখবেন যে পুজোর উৎসবে খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে অবাঙালি সংস্কৃতির প্রভাবটা বাড়ছে। বঙ্গীয় সংস্কৃতির প্রভাব ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন- সাবেক পুজো নাকি থিম পুজো কোনটা বেশি কাছের ?
বিকাশ ভট্টাচার্য- দেখুন যদি আপনি আমাকে স্পষ্ট কথা বলতে বলেন তাহলে বলবো কোনোটাতেই পুজো হয়না। পুজোকে সামনে রেখে চূড়ান্ত উৎসব হয়। এবং বাঙালিরা সেই উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ভেসে থাকে। যারা অঞ্জলি দিতে যান তারা কিন্তু উৎসব করতেই যাচ্ছেন। অঞ্জলি দেওয়াটা তাদের কাছে অনেকটা ওই সকলে হয় হয় করে গেলাম ওটাই। এর মধ্যে আমি তথাকথিত ভক্তি বা পূজার কোনো কিছু উপাদান খুঁজে পাই না।
প্রশ্ন- মণ্ডপে মণ্ডপে যান প্রতিমা দেখতে?
বিকাশ ভট্টাচার্য- দেখুন আমি যখন স্কুলে পড়তাম কালীঘাটে থাকতাম। তখন মনে আছে আমাদের চারপাশে কয়েকটা নামকরা পুজো ছিল সেগুলো হচ্ছে সঙ্ঘশ্রী ,সেই কৈলিন্য সেখানে ছিল না খুব একটা। নানান বিচিত্র ব্যবস্থাপনা করতেন তারা মণ্ডপে। এছাড়াও ছিল হরিশপার্কের পুজো , হাজরা পার্কের পুজো এবং আর একটু এগিয়ে গিয়ে সংঘমিত্র বলে একটি পুজোর কথা মনে আছে। এইটুকুই ছিল তখন আমাদের যাতায়াতের পরিধি। আর যখন ওই রাস্তাটা হয়নি তখন ওখানে একটা মেলা হতো। সেখানে গিয়ে নাগরদোলা চড়া ইত্যাদি হতো। সেইসবের অকর্ষণ ছিল। এগুলো কিন্তু ছিল প্রকৃত বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। নাটক হতো। পুজোয় গানের অনুষ্ঠান হতো। পাড়ার ছেলেমেয়েরা সেখানে অংশগ্রহণ করতো। আজকাল এসব উঠে গেছে এখন অনুষ্ঠান করলে আমরা বড়ো বড়ো শিল্পীদের টাকা দিয়ে ডেকে নিয়ে আসি। আমার পরিবারের ছেলেমেয়ে বা পাড়ার ছেলেমেয়ে তাদের দিয়ে কোনো অনুষ্ঠান করা হয় না।
প্রশ্ন- পুজোর দিনগুলো কোন রুটিনে দিনটা শুরু করেন?
বিকাশ ভট্টাচার্য- নিশ্ছিদ্র অবসর। কোনো টানাপোড়েন নেই। যখন খুশি খেতে যাওয়া যখন খুশি ঘুমোতে যাওয়া , অন্য কোনোরকম টানা পড়েন থাকে না ,কাজ থাকে না। পুজোর চার পাঁচ দিন খুব আনন্দেই থাকি কারণ কেউ বিরক্ত করবে না। আর পুজোর এই কদিন আমার বিশ্রামের ভালো সময়। ঘুম থেকে ওঠবার তাড়া নেই। অন্য কোনো কাজেরও তারা নেই। যখন খুশি ঘুম থেকে উঠলাম তারপর নিজের পড়াশুনা বা গান শোনার মধ্যে দিয়েই আমার সময় কাটে। এর বাইরে কিছু না আর আজকাল ওই যেটা আগেও ছিল এখনো আছে সেটা হলো ওই বিভিন্ন পাড়ায় বুকস্টল হয় তারা ডাকেন বুকস্টলে যাবার জন্য দু চার কথা বলার জন্য
প্রশ্ন- এমন কোনও পুজো জাস্ট রাজনৈতিক কারণে অন্যদিকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে?
বিকাশ ভট্টাচার্য- না, সত্যি কথা , ঠিক তেমন কোনোদিন হয়নি। পুজোর এই চারটি দিন মূলত আমাদের কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকে না। যেটা থাকে সেটা হলো বিভিন্ন জায়গায় বইয়ের স্টল হয় সেখানে যাওয়া , ঘোরা সেটাকে আমি সবসময় পুজোতে আনন্দ করার অংশ হিসাবেই দেখেছি। এছাড়াও অনেকে বলেন আপনাকে বইমেলায় আস্তে হবে উদ্বোধন করতে হবে, এইসবই চলে। এছাড়া আর কিছু নয়।
প্রশ্ন- পুজোর দিনে পুরনো দিনের বন্ধুদের সঙ্গে কি আড্ডাটা আজও হয়?
বিকাশ ভট্টাচার্য- হ্যাঁ , কখনো কখনো হয়তো হয়। তারাও তো সকলে ব্যস্ত তাও পুজোর দিনে আমরা কখনো একজায়গায় জড়ো হয় আড্ডা মারতে। সেটা হয়
প্রশ্ন- এবারের পুজো প্ল্যান কেমন?
বিকাশ ভট্টাচার্য- (একটু হেসে ) কোনো প্ল্যান নেই। এবছর একটা অভিনব বিষয় হচ্ছে সল্টলেকের একটি দুর্গাপুজো একটি আলোচনাসভার আয়োজন করেছেন সেখানে যেতে হবে। এছাড়া ওই সস্থির দিন কিছু বই বিক্রির কেন্দ্র উদ্বোধন করতে হবে ,সপ্তমীর দিনও করতে হবে। এই।
প্রশ্ন-এক কথায় যদি জানতে চাই পুজো মানে আপনার জীবনে কি?
বিকাশ ভট্টাচার্য- পুজো মানে হচ্ছে আমার জীবনে চূড়ান্ত স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে পূজার কার্যক্রম করা। তবে পুজোতে চাঁদার নামে ব্যাপক জুলুম হয়। এই তো সেদিন দেখলাম যেটা আমি পোস্টও করেছি যে নিউ আলিপুর অঞ্চলের একটি ক্লাব তারা মাইকে ঘোষণা করে বলছেন যে " ৪০০ টাকার কম কেউ চাঁদা দেবেন না। আপনার বাড়ির বাইরে আমরা এসেছি। আপনারা চাঁদা দিয়ে যান।" এই ঔদ্ধত্য ভাবা যায় না। আগে বারোয়ারি পুজো মানে ছিল সকলের অংশগ্রহণ আর চাঁদা দেওয়াটা ছিল ওই অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটা দায়বদ্ধতা। যে যেমন পারলেন তারা সকলে মিলে অংশগ্রহণ করছেন। তবে আগে যে সামাজিক বোধটা ছিল সেটা বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছে। তাই আজকাল সকলের এমন স্পর্ধা বাড়ছে তাই তারা বলছে ৪০০ টাকার কম চাঁদা নেবো না।
প্রশ্ন- আপনার জীবনের দুর্গা কে?
বিকাশ ভট্টাচার্য- প্রত্যেকের জীবনেই একজন আমার দুর্গা থাকে। মানে এমন একজন নারীশক্তি যে কিনা আপনাকে সবসময়ই খুব ইন্সপায়ার করে। আপনার জীবনে সেরকম কোনো আমার দূর্গা আছে ?
প্রথমত মা দুর্গার কনসেপ্টটা আমার কাছে খুব ভিন্ন। মা দূর্গা আমার কাছে হচ্ছে আর্যদের প্রতীক যারা আমার দেশবাসীকে , আদিবাসীদের হত্যা করেছেন। যাদের অসুর বলে চিহ্নিত করা হয় তারা প্রকৃতপক্ষে আমাদের আদিবাসী। মা দুর্গাকে পরিচয় করানো হয় তিনি দুর্গতি নাশিনী এইভাবে। কিন্তু তিনি যে শত্রুবিনাশিনী ইটা সম্পূর্ণ উচ্চ বর্ণের লোকেদের প্রচার। সেইজন্য মা দূর্গা -এইভাবে কখনো কাউকে ভাবিনা কিন্তু নিঃসন্দেহে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই একজন নারীর প্রভাব থাকে। আবার নারীর জীবনেও পুরুষের প্রভাব থাকে ইটা একটা প্রাকৃতিক ঝোঁক। আমার যিনি জীবনসঙ্গিনী ছাত্রাবস্থা থেকেই তার সাথে আমার বন্ধুত্ব। এবং জীবনের ওঠাপড়া বা অনেক দুর্যোগেই তিনি সমর্থন করেছেন , পাশে থেকেছেন তো সবার আগে তার ভুমিকাকেই আমি মনে করি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আমার জীবনে।
আরও পড়ুন পুজোর ভিড়ে নেই দিলীপ ঘোষ, চললেন নৈনিতাল, পুজোর আড্ডায় অকপট বিজেপি নেতা