যতদুর জানা যায় বঙ্গদেশের প্রাচীনতম দুর্গাপুজো বলতে তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ যে পুজো শুরু করেছিলেন সেটি। অনেকে নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের নেদিয়ায় রাজা ক্রিষ্ণচন্দ্র-র বাবা কৃষ্ণরাম সেনের পুজোর উল্লেখ করে থাকেন। কারও মতে বঙ্গদেশের আদি দুর্গাপুজো ১৫২৬ সালে সংকোশ নদীর ধারে চামটা গ্রামে (কোচবিহার) কোচ রাজা নরণারায়ন যে বড়দেবীর বন্দনা শুরু করেছিলেন সেটি।
তবে কৃষ্ণরাম সেনের ত্রিভূজা দুর্গামূর্তির পুজো বেশ কিছু কাল ধরে চলছে হুগলি জেলার বলাগড় এলাকার সোমরা গ্রামের রায়বায়ান রাজা রামচন্দ্র সেনের দুর্গা দালানে। এখানকার সপরিবার দুর্গা মূর্তিটি প্রায় অদৃশ্যমান এবং অপ্রকট। মূর্তিটির বাঁ দিকে একটি হাত ও ডান দিকে দুটি হাত শুধুমাত্র দেখা যায় বাকি হাতগুলি ছোট আঙুলের মতো দেহের পিছনে চুলের মধ্যে মিশে থাকে।
ত্রিভূজা সিঙ্ঘবাহিনি এই দুর্গামূর্তির লৌকিক নাম ত্রিভূজা দুর্গা। বঙ্গদেশের আর কোথাও এই দুর্গামূর্তির পুজো হয় না বলেই এখন পর্যন্ত খবর। কেবল তাই নয় এ ধরণের দুর্গামুর্তি রামচন্দ্র সেনের দুর্গা দালান ছাড়া অন্য কোথাও নজরে পড়বে না। তবে দ্বিভূজা দুর্গামূর্তির পুজো কোথাও কোথাও আছে বলে শোনা যায়। যেমন বলাগড় এলাকার পাটুলি গ্রামের মঠবাড়ির পুজো। এখানে দ্বিভূজা মূর্তিতে দুর্গাপুজো হয়। তন্ত্রাচারে এই পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এই মূর্তির দুটি হাত কেবল দেখা যায়, বাকি হাতগুলি মূর্তি চুলে ঢাকা পড়ে যায়।
হুগলি জেলার বলাগর ছাড়াও দু’হাতের দুর্গাপুজো হয় বীরভূম জেলার মল্লারপুরের জমিদার জগন্নাথ রায়ের বাড়িতে। প্রায় ৩০০ বছর ধরে দু’হাতের দুর্গামূর্তি এই বারিতে পুজো হয়ে আসছে। প্রতিমার ডান হাতে অভয় মুদ্রা আর বাঁ হাতে পদ্ম। তবে এই দুর্গামূর্তির সঙ্গে থাকে না লক্ষ্মী, গনেশ কার্তিক ও সরস্বতী।
যুগে যুগে কালে কালে মূর্তির রূপের রদবদল ঘটেছে মানুষের কল্পনায়। যদিও মানুষের গল্পকথায় দেবী রূপ বদলে কখনও দশভূজা রণাঙ্গিণী, কখনও অতসী বা গোধূমবর্ণা, কোথাও নীলজীমূত সঙ্কাশা। তাই হয়ত কবি নজরুল লিখেছে, ‘মানুষ এনেছে দেবতা, দেবতা আনেনি মানুষ’।
দুর্গা শুধু দেবী রূপেই নয়, কোথাও পুজো পেয়ে থাকেন সাধারণ রূপেও। চ্যাপ্টা নাক, পটলচেরা চোখ, একেবারে জৌলুসহীন সাধারণ এক গ্রাম্য মেয়ে-এই রূপকে আরও নির্দিষ্ট করে বলা যায় রাজবংশী নারী রূপ। ১৮১০ সাল থেকে দেবী দুর্গা এই রূপেই বন্দিত হয়ে আসছেন জলপাইগুড়ি জেলার ময়নাগুড়ি ব্লকের আমগুড়ি এলাকায়।দুশো বছরের বেশি সময়কাল ধরে দুর্গাকে এই রূপেই দেখে আসছেন এখানকার মানুষ। দেবি দুর্গাও এখানে সাধারণ রাজবংশী মেয়ে হিসাবেই মানুষের পুজো পেয়ে আসছেন। এই পুজো করে আসছেন আমগুড়ির বসুনিয়া পরিবার। তবে বসুনিয়া পরিবারের দুর্গা রাজবংশী পরিবারের মেয়ে হলেও তাঁর গায়ের রং লাল।
অন্যদিকে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহর থেকে ১৫ কিমিদূরে বোয়ালদাঁড় গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্ভূক্ত ফুলহারা গ্রামে যে দুর্গাপুজো হয় সেই দেবী মূর্তি আসলে মনসা। আত্রেয়ী নদী সংলগ্ন এই গ্রামে প্রায় শ’খানেক পরিবারের বাস। গ্রামবাসীরা বহুকাল ধরেই নিষ্ঠাভরে দুর্গা পুজো করে আসছেন। কিন্তু তাদের অসুরদলনী মনসা রূপেই বন্দিত হন হয় সন্ধিপুজো থেকে দশমী পর্যন্ত। মনসা হলেও পুজো হয় দুর্গা পুজোর সব রীতিনীতি মেনে। ফুলহারা গ্রামের দুর্গামূর্তির রুপ মনসা হওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয়; বহুকাল আগে এই গ্রামে ভয়ংকর সাপের উপদ্রব দেখা গিয়েছিল। সাপের উপদ্রব যাতে কমে তার জন্য গ্রামের একজনের বাড়িতে মনসা পুজো আরম্ভ হয়েছিল। তাতে নাকি সাপের উপদ্রব কমেছিল। এরপর থেকে গ্রামে দুর্গা পুজোর প্রচলন হলেও তারা মনসারূপী দুর্গামূর্তি বেছে নেয়।
অভিনব আরেক দুর্গামুর্তির খজ পাওয়া যায় মুর্শিদাবাদ জেলার রানিনগর থানা এলাকার ইসলামপুর গ্রামে। এখানে আড়াইশো বছরের বেশি সময় ধরে বাইশ মূর্তির দুর্গাপুজ হচ্ছে। লোকশ্রুতি মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারের রাজারা এ ধরনের দুর্গামূর্তির পুজো করতেন। তারপর তা সাধারনের মধ্যেও ছড়িয়ে পরেছিল। তবে ইসলামপুর গ্রামের দুর্গামূর্তি একদিকে যেমন লক্ষ্মী-সরস্বতী-গনেশ-কার্তিক সমেত, অন্যদিকে দশভূজার মাথায় থাকেন মহাদেব,হংসারূড় চতুর্মূখ ব্রম্মা এবং নারায়ণ। মহাদেবের দু’পাশে দুই অনুচর নন্দী, ভৃঙ্গী। কার্তিক-গনেশের দু’পাশে থাকেন দুর্গার দুই সখা জয়া-বিজয়া। এছাড়াও থাকেন বহু পৌরাণিক মূর্তি। মোট বাইশটি মূর্তি নিয়ে এই দুর্গা প্রতিমার পুজো হয়ে আসছে ইসলামপুর গ্রামে।