লর্ড কর্ণওয়ালিস এসেছিলেন দর্জি পাড়ার মিত্রবাড়ির পুজোয়। এই বাড়ির পুজোয় কোথাও এতটুকু বৈভবের আতিশয্য নেই যেটুকু আছে তা নিখাদ ভক্তি।
১৯/সি নীলমণি মিত্র স্ট্রিটের মিত্রবাড়িকে একডাকে সবাই চেনে। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত এই রাস্তা নীলমণি মিত্র স্ট্রিট যাঁর নামে, তাঁর ছেলে রাধাকৃষ্ণ মিত্র এই পুজোর প্রবর্তন করেন। মিত্র বাড়ির অনসূয়া বিশ্বাস মিত্রর সাথে আলাপচারিতায় অনিরুদ্ধ সরকার।
মিত্রবাড়ির আদিপুরুষের ইতিহাস-
আড়িয়াদহ থেকে ভাগ্যান্বেষণে সুতানুটি অঞ্চলে আসেন এই পরিবারের জগন্নাথপ্রসাদ মিত্র। রাঢীয় কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত দর্জিপাড়া মিত্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা তিনিই। তিনি কী ব্যবসা করতেন তা জানা যায় না। তবে তাঁর পৌত্র দুর্গাচরণ ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার ‘কোর্ট জুয়েলার’। এছাড়াও তাঁর বহুবিধ ব্যবসা ও নুনের দেওয়ানি ছিল। সেই কাজের দফতরে একদা কাজ করতে আসেন সাধক-কবি রামপ্রসাদ সেন। হিসেবের খাতায় তাঁর লেখা গান পড়ে খুশি হয়ে হয়ে দুর্গাচরণ রামপ্রসাদকে আজীবন মাসোহারার ব্যবস্থা করে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সাহিত্য-সংগীতচর্চার জন্য। দুর্গাচরণের ভ্রাতুষ্পুত্র নীলমণি মিত্রও ছিলেন সে যুগের একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি। নীলমণি মিত্রর পৌত্র তথা রামদুলাল সরকারের জামাই ছিলেন রাধাকৃষ্ণ মিত্র। যিনি ছিল একজন নামকরা আমদানি-রফতানির ব্যবসায়ী।
পুজো শুরু কখন থেকে-
দুর্গাচরণের ভ্রাতুষ্পুত্র নীলমণি মিত্রর পৌত্র বিখ্যাত ব্যবসায়ী রামদুলাল সরকারের জামাই রাধাকৃষ্ণ মিত্র ১৮০৬ সাল নাগাদ দর্জিপাড়া মিত্রবাড়ির দুর্গোৎসবের সূচনা করেন।রাধাকৃষ্ণ মিত্রর মেজো ছেলে রাজকৃষ্ণ মিত্রের বংশধরেরা এই পুজো করে আসছেন। রাধাকৃষ্ণ মিত্রের পঞ্চম বংশধরের কোনও ছেলে না থাকায় এখন বাড়ির মেয়েরাই এই পুজো পরিচালনা করেন।২১৬ বছরে পড়ল এই পুজো।
পুজো পদ্ধতি-
তিনচালা প্রতিমা। এখানে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর দেবীমুখ এবং কার্তিক ও অসুরের মুখ বাংলা ধাঁচের হয়। বাংলা ধাঁচের মুখের বিশেষত্ব হল, প্রতিমার চোখ সাধারণ মানুষের মতোই। অন্যদিকে দেবীমুখ বলতে বোঝায় টানা টানা চোখের প্রতিমা। পুরনো সেই দেবীর মুখের ছাঁচ আজও সংরক্ষণ করে রাখা আছে। পিছনে মঠচৌড়ি। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতীর পিছনে তিনটি অর্ধবৃত্ত। তার উপর মাটির নকশা করা তিনটি মঠের চূড়ার আকৃতির চালি। দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে পরানো হয় ডাকের সাজ। কোঁচানো ধুতি পরেন কার্তিক, গণেশ। সিংহ ঘোড়ামুখো । এ পুজোর যাবতীয় সাজ কিন্তু পরিবারের সদস্যদের হাতে। পদ্ম নয়, ১০৮ টি নীল অপরাজিতা ফুলে সন্ধিপুজো হয়।
ভোগবৃত্তান্ত-
এখানে চাল ও ফলের সঙ্গে খিচুড়ি ও মিছড়ি-মাখনের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। অব্রাহ্মণ পরিবার বলে অন্নভোগ দিতে পারেন না ৷ রান্না করা ভোগের বদলে কাঁচা আনাজে হলুদ মাখিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয় ভোগের থালা। সব শেষে পানের খিলি।
দেবীকে দেওয়া হয়, 'ঝাড়খিলি পান' -
পানের খিলি দেওয়া হয় দেবীকে। পান পাতার শিরা দিয়ে তৈরি হয় এই খিলি পান। যা দেখতে অনেকটা ঝাড়বাতির মত। আদরের নাম ঝাড়খিলি। ফুলের পাপড়ির আকারে চারপশে সাজানো থাকে নানা রকম পানমশলা। দশমীর দেবীবরণের পর প্রতিমার মুখে দেওয়া হয় সুগন্ধি ছাঁচিপান আর হাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এই ঝাড়খিলি পান। প্রথমে দুর্গা, তার পর একে একে অন্য প্রতিমার হাতে। গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতীর পাশাপাশি সিংহ, ময়ূর-সহ সব দেবতার বাহনদেরও এই পান দেওয়া হয়। দশমীতে মোট ২৭টি পানের ঝাড়খিলি তৈরি করা হয় সকলের জন্য।
দশমীর বিদায়-
ঠাকুরদালান থেকে ছেলেদের কাঁধে চেপে উঠোনে নামেন উমা। শুরু হয় প্রদক্ষিণ, বরণ, সিঁদুর খেলা। মেয়েরা শাঁখা পলায় সিঁদুর ছুঁয়ে, মুখে পানের খিলি, মিষ্টি গুঁজে দেবীবরণ করে বিদায় জানান। এখানে আজও কাঁধে করে দেবীকে নিয়ে যাওয়া হয় গঙ্গার ঘাটে ৷ সেখানেই হয় বিজসর্জন ৷ ধুতি পরে, লাঠি হাতে, খালি পায়ে বাড়ির পুরুষরা গঙ্গায় বিসর্জন দিতে যান উমাকে।
আরও পড়ুন-
ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজের নিলাম থেকে বুলবুলির লড়াই, ছাতুবাবু লাটুবাবুর বাড়ির দুর্গাপুজোর কাহিনীটি বড়ই অদ্ভুত!
পেতলের টিকিট দেখিয়ে চোরবাগানের শীল বাড়ি থেকে টাকা পেতেন গরীব-দুখীরা, জেনে নিন সেই বাড়ির দুর্গাকথা
বিদ্যাসাগরের বহু আগে বিধবা বিবাহ দিয়েছিলেন মতিলাল শীল, তাঁর দুর্গাপুজোর জমকে তাক লেগেছিল সমস্ত কলকাতাবাসীর