দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে না, কাঁসর সানাই সহযোগে ঢোলের তালে আনন্দে নাচেন বীরভূমের সুরুল রাজবাড়ির পুরুষরা

Published : Oct 02, 2022, 06:41 PM IST
দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজে না, কাঁসর সানাই সহযোগে ঢোলের তালে আনন্দে নাচেন বীরভূমের সুরুল রাজবাড়ির পুরুষরা

সংক্ষিপ্ত

সপ্তমীর সকালে দোলা নিয়ে পুকুর ঘাটে ঘট ভরতে যাওয়ার সময় থেকে শুরু হয়ে যায় পুজোর জাঁকজমক। বাঁশির বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন্দিরের সামনের দোতলা বারান্দা থেকে ক্ষীরের নাড়ু নীচে ছোঁড়েন বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা। 

বোলপুরের সুরুল গ্রামের সরকারবাড়ির পুজো এ বার ২৮৮ বছরে পড়ল। জমিদারবাড়ির পুজো হিসাবে আজও সমাদৃত এই পুজো। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনের জমি অনেকটাই কিনেছিলেন সুরুলের সরকার পরিবারের কাছ থেকে। সুরুলের সরকার বাড়ির পুজোর অজানা কথা শোনাচ্ছেন অনিরুদ্ধ সরকার। 

পুজো শুরু কবে থেকে- 
কারো মতে শ্রীনিবাস সরকার  পুজোটির প্রবর্তক। যদিও রাজবাড়ির ইতিহাস বলছে, পুজো শুরু ভরতচন্দ্র সরকারের হাত ধরে। এই বাড়ির প্রকৃত পদবি সরকার নয়। ইংরেজদের থেকে পাওয়া উপাধি। পরিবারের আদি পদবি ঘোষ। ইতিহাস বলছে, ভরতচন্দ্রের আমলে পুজো শুরু হলেও ছেলে কৃষ্ণহরির আমলেই জাঁকিয়ে পুজো শুরু হয়।


ইতিহাস- 
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বর্ধমানের নীলপুরের ঘোষবাড়ির ছেলে ভরতচন্দ্র সস্ত্রীক চলে আসেন সুরুলে। তাঁর গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে। সুরুল ছিল বৈষ্ণব ধর্মগুরু বাসুদেবের শ্রীপাট। ভরতচন্দ্র গুরুদেবের শ্রীপাট ছেড়ে আর ফিরে যাননি বর্ধমানে। তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরি ও তাঁর ছেলেরা সেই সময় ফরাসি ও ইংরেজ কুঠিয়ালদের সঙ্গে ব্যবসা করে পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি করেন। সম্পত্তি ও প্রতিপত্তির দৌড়ে কৃষ্ণহরিকে অবশ্য টেক্কা দেন তাঁর নাতি শ্রীনিবাস। পাঁচ খিলানের একটি ঠাকুরদালান নির্মাণ করান শ্রীনিবাস। সেযুগে যা নির্মাণে খরচ পড়েছিল আঠারো হাজার টাকা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সরকার পরিবার সুরুলের স্থানীয় বাণিজ্যকুঠিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট জন চিপ সাহেবের সঙ্গে ব্যবসা করে সম্পদ বৃদ্ধি করেছিল। জাহাজের পাল তৈরি হত যে কাপড় দিয়ে সেই কাপড়, নীল, চিনি এসবেরই ব্যবসা ছিল সরকারদের। 

দু' তরফের পুজো- 
কৃষ্ণহরির মৃত্যুর পরে তাঁর তিন ছেলে যাদবেন্দ্র, মাধবেন্দ্র ও কালীচরণের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা এতটাই তুঙ্গে ওঠে যে জমিদারি ভাগ হয়ে যায়। যাদবেন্দ্র ও কালীচরণ একসঙ্গে থাকেন আদি বাড়িতে। লোকমুখে তাঁরা "বড় তরফ"। পাশেই বাড়ি করে আলাদা হয়ে যান মাধবেন্দ্র, তিনিই 'ছোট তরফে'র প্রতিষ্ঠাতা।


পুজো পদ্ধতি -
প্রতিমা শিল্পীরা বংশ পরম্পরায় মূর্তি তৈরি করে আসছেন। রুপোলি রংয়ের ডাকের সাজে সাজানো হয় মাকে। সপ্তমীর সকালে দোলা নিয়ে পুকুর ঘাটে ঘট ভরতে যাওয়ার সময় থেকে শুরু হয়ে যায় পুজোর জাঁকজমক। চলে আগমনীর নানা গান। জমিদারবাড়িতে দোলা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঢোল, বাঁশির বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মন্দিরের সামনের দোতলা বারান্দা থেকে ক্ষীরের নাড়ু নীচে ছোঁড়েন বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা।

পুজোয় বলি প্রথা- 
এই বাড়িতে বলি এখনও চালু রয়েছে। সপ্তমীতে চালকুমড়ো, অষ্টমীতে একটি কালো ছাগ ও নবমীতে আখ ও চালকুমড়ো বলি হয়।বৈষ্ণব মতে পুজো হলেও অষ্টমীতে ছাগল বলি হয়।আগে বলির পরে বন্দুক ছোঁড়া হত। সেটাই ছিল গ্রামের জন্য অষ্টমী পুজো শুরুর ইঙ্গিত। সরকার বাড়ির বলি শেষ হলে সুরুলের অন্যান্য বাড়িতে পুজোয় বলি হত। 

দশমীর রেওয়াজ-
দশমীর দিন সকাল থেকে অপরাজিতা গাছে তাগা বাঁধার রেওয়াজ আছে। প্রচুর মানুষ আসেন তাগা বাঁধার জন্য।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান -
তিনদিন সন্ধ্যায় মন্দিরের সামনের আটচালায় অনুষ্ঠিত হয় যাত্রাপালা। পুজো উপলক্ষে বসত মেলা।আজও এই অনুষ্ঠানগুলি হয়ে থাকে নিয়মমাফিক।


ভোগ বৃত্তান্ত- 
সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত ১১০ থালার ভোগ দেওয়া হয় মাকে। তার মধ্যে ৯টি নৈবেদ্য হয় আতপ চালের। বাকি সব মিষ্টি ও গাওয়া ঘিয়ে ভাজা লুচি। নারকেল নাড়ুও হয় এক থালা। সঙ্গে থাকে মিহিদানা, কালোজাম, রসগোল্লা, লাড্ডু ইত্যাদি মিষ্টি। সবই তৈরি করেন বাড়ির সদস্যরা।

ঢাকের জায়গায় বাজে ঢোল- 
পুজোয় সরকার বাড়িতে ঢাক বাজে না। তার জায়গা নেয় ঢোল। সঙ্গতে কাঁসর ও সানাই। তার তালে সন্ধ্যায় বাড়ির ছেলেরা নাচ করেন।

আরও পড়ুন-
পটাশপুরের পাঁচেটগড় রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর সঙ্গে কীভাবে জড়িয়েছিলেন মোঘল সম্রাটরা?
সাদা রঙের সিংহ, তপ্ত কাঞ্চনবর্ণা প্রতিমা, বৈকুণ্ঠপুর রাজবাড়িতে দুর্গাপুজোয় পূজিতা হন দুর্গার দুই সখীও

‘বর্গী এল দেশে’, আর সেই বর্গীদের রুখে দিলেন রানি জানকী, তিনিই শুরু করলেন মহিষাদল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো

PREV
Read more Articles on
click me!

Recommended Stories

Durga Puja 2025: সঙ্ঘাতির 'দ্বৈত দুর্গা' থিমে বাংলার দুর্গা এবং শেরাওয়ালি মাতা, বিষয়টা ঠিক কী?
Durga Puja 2025: দুর্গাপুজোয় চাঙ্গা রাজ্যের অর্থনীতি? ১০-১৫% বৃদ্ধির সম্ভাবনা, আনুমানিক ৪৬,০০০-৫০,০০০ কোটি টাকা