বাংলায় নিজেদের ভিত শক্ত করতে চেষ্টার কসুর করেননি বিজেপি নেতারা। ২০১৪ থেকে শুরু করে ২০১৬-র বিধানসভা ভোট, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন, ভোট শতাংশ বৃদ্ধিতেই বাংলায় আটকে থেকেছে গেরুয়া শিবির। ভোটের ফলে বহু কাঙ্খিত সংখ্যা পায়নি এ রাজ্যে অন্তত পায়নি বিজেপি। তাই তৃণমূলের সঙ্গে সমানে সমানে টক্কর দিয়েও কাজের কাজটা করতে পারেনি পদ্ম শিবির।
২০১৯-এ এসে কি বহু কাঙ্খিত সেই সংখ্যা এ রাজ্য থেকে পাবে বিজেপি? একবার যদি তা করতে পারে গেরুয়া শিবির, তাহলে কিন্তু ২০২১-এর আগে অনেকটাই কাজ সেরে রাখতে পারবে তারা। এক্সিট পোলের হিসেব তাই মমতার কাছে সত্যিই চিন্তার। যার উত্তর পাওয়া যাবে বৃহস্পতিবার। কারণ মমতার ভয় তাঁর নিজের দল এবং সংগঠনকেই।
এতদিন এ রাজ্য থেকে বিজেপি-র সাংসদ সংখ্যা ছিল দুই। বিধানসভায় প্রতিনিধি বলতে মাত্র তিনজন। এক্সিট পোলের হিসেব মিলিয়ে যদি সত্যিই এ রাজ্য থেকে দশটির বেশি আসনে বিজেপি জিতে যায়, তাহলে একধাক্কায় বাংলায় বিজেপি-র সাংগঠনিক দুর্বলতা অনেকটাই যে কেটে যাবে, তা একরকম অবধারিত। গেরুয়া শিবিরের সাফল্য মানে নিশ্চিতভাবে তৃণমূলের আরও কিছুব নেতা সেদিকে ঝুঁকবেন, সঙ্গে যাবেন তাঁদের অনুগামীরা। ঠিক যেভাবে ২০০৯ সাল থেকে লোকসভা, পুরসভা এবং বিধানসভায় তৃণমূলের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাম, কংগ্রেস থেকে দলে দলে নেতা-কর্মীরা ভিড় জমাতে শুরু করেছিলেন তৃণমূলে। অন্যদল থেকে হাজারে হাজারে আসা সেই কর্মী, সমর্থকদের ভিড়েই পুষ্ট হয়েছিল তৃণমূলের সংগঠন। বিজেপি যে অন্য পথে হাঁটবে, তা ভাবার কোনও কারণ আছে কি?
এখনও পর্যন্ত বিজেপি নেতারা একবারও বলেননি যে তৃণমূল থেকে আসা নেতা-কর্মীদের তাঁরা দলে নেবেন না। বরং তৃণমূলকে ভাঙাটাই যেন বিজেপি-র একমাত্র লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যেই মুকুল রায়ের মতো নেতাকে দলে টানা। এতদিন অর্জুন সিংহ, শঙ্কুদেব পণ্ডা, অনুপম হাজরার মতো যে নেতারা তৃণমূল থেকে বিজেপি-তে গিয়েছিলেন, তাঁদের তৃণমূলে কার্যত আর কিছু পাওয়ার ছিল না। কিন্তু বিজেপি-র লক্ষ্যই তৃণমূলের মূলে আঘাত করা। তার জন্য দরকার সংখ্যা। যে সংখ্যা দেখে শাসক দলের তাবড় নেতাদেরও মনে হয় যে বিজেপি-তে গেলে তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। তাহলে তৃণমূলের খারাপ সময়ে ওই নেতাদেরও একটা হিল্লে হয়ে যাবে, আবার রাজ্য রাজনীতিতে পরিচিত মুখ কিছু নেতাও বিজেপি পেয়ে যাবে। যাঁদের হাত ধরে তৃণমূলের সংগঠনকে নিজেদের দিকে টেনে আনা যাবে। নেতা, সমর্থক, কর্মীরা একই থাকবেন, শুধু জোড়াফুলের বদলে তাঁদের গায়ে পদ্মের ছাপ পড়ে যাবে। ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে দুই তৃণমূল সাংসদ বিজেপি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে দিয়েছেন, ২৩ মে-র পর হাওয়া বুঝে এমন ফোন আরও অনেক তৃণমূল নেতা করতেই পারেন। বিজেপি-ও সেই অপেক্ষাতেই আছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও তা খুব ভাল করে জানেন। যাঁরা তাঁর উন্নয়ন যজ্ঞে সামিল হতে এতদিন এ দল, ও দল থেকে তৃণমূলের ছাতার নীচে এসেছেন, তাঁরা যে নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়ন যজ্ঞে সামিল হওয়ার সুযোগ পেলে ছাড়বেন না, একথা বলাই বাহুল্য। মমতার হাতে গড়া সংগঠনের উপর ভরসা করেই তখন তাঁকে সরিয়ে নবান্নের দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠবে গেরুয়া শিবির। তৃণমূলে যতই তিনি শেষ কথা হোন না কেন, রাজ্য রাজনীতিতে পরিচিত মুখ কয়েকজন নেতা বিজেপি-তে নাম লেখালেই আগল খুলে যেতে বাধ্য। তখন নিজেদর দলকে রক্ষা করাই কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে তৃণমূল নেত্রীর কাছে। তার সঙ্গে নারদা, সারদার মতো ঘটনা কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার চাপ তো আছেই। তাই বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ না হোক, বৃহস্পতিবার অন্তত নিজের দলের নেতাদের ধরে রাখার মতো সংখ্যা ভীষণই দরকার মমতার। দিল্লিতে সরকার গড়তে তিনি কতটা নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারবেন, সেই হিসেবনিকেশ তো থাকবেই, কিন্তু বাংলায় দল ভেঙে যাওয়ার এই আশঙ্কা কি বৃহস্পতিবারের আগে একেবারে উপেক্ষা করতে পারবেন তৃণমূল নেত্রী।