বছর তিনেক আগে বীরভূমের ইলামবাজারে এক কলেজ পড়ুয়ার আপত্তিকর পোস্ট ঘিরে হিন্দু মুসলিম সংঘর্ষ বেধে ছিল। পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক সংঘর্ষ প্রায়শই দেখে থাকলেও, সেই ১৯৪৬ সালের পর থেকে বাংলায় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা আর দেখেনি। ফলে বেশ ব্যতিক্রমী ছিল সেই ঘটনা। এক যুবকের মৃত্যুও হয়েছিল।
তারপর থেকে কিন্তু গত কয়েক বছরে ইতিউতি অনেক জায়গাতেই সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। বিজেপি সভাপতি মাঝে মাঝেই আহ্বান করেছেন হিন্দুদের 'আত্মসম্মান' রক্ষার। টিএমসির বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করেছেন মুসলিম তোষণের। আর তারই ফসল ইভিএম-এ তুলেছে বিজেপি, এটাই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
লোকসভা নির্বাচন ২০১৯-এর ভোট গণনা অনেকদূর হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে আসন-প্রাপ্তি সংখ্যায় কখনও তৃণমূল কংগ্রেস ২৫টি ও বিজেপি ১৬ টি, আবার কখনও টিএমসি কমছে, আসন বাড়ছে বিজেপির। একটি বিষয় পরিষ্কার বিপুল শক্তি বৃদ্ধি ঘটছে বিজেপির। গত লোকসভা নির্বাসনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পেয়েছিল ১৭.০২ শতাংশ, আর তৃণমূল পেয়েছিল ৩৯.০৫ শতাংশ। এই বছর এখনও অবধি তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ৪৫ শতাংশ এবং বিজেপি রয়েছে প্রায় গায়ে গায়ে ৩৯ শতাংশ (গণনা শেষ হলে এই অঙ্কে কিছু বদল হতে পারে)। রাজনৈতিক মহলের মতে, পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে এই নির্বাচন একেবারেই ব্যতিক্রমী নির্বাচন। যেখানে স্পষ্ট ভোট ভাগ হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে।
বাংলা ইতিহাসে দুইবার হিন্দু-মুসলমানের মধ্য়ে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা দেখেছিল। প্রথমবার ১৯০৫ সালে, দ্বিতীয়বার ১৯৪৬ সালে। দুইবারই বঙ্গভঙ্গের পরিস্থিতি ছিল। কিন্তু ১৯৪৬ সালের সেই 'গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং' ও 'নোয়াখালি'-র দাঙ্গার ভয়াবহতা বাংলার মানুষের মানসিকতাই বদলে দিয়েছিল। তারপর থেকে এতদিন পর্যন্ত ধর্মীয় ভেদাভেদ বাংলায় মাথাচাড়া দেয়নি। এমনকী বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় যখন সারা ভারত অশান্ত হযেছিল, বাংলায় তার প্রভাব পড়েনি। স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকের কংগ্রেস শাসন ও তিন দশকের বাম জমানায় অন্তত প্রত্যক্ষভাবে জাতপাতের রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়নি বাংলা।
কিন্তু, ২০১৯-এর ভোটের ফল বের হতেই যেভাবে বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে আসন ভাগাভাগি হয়ে গিয়েছে, তাতে জাতপাতের, ধর্মের রাজনীতিই এবার প্রধান ইস্যু হয়েছে এই রাজ্যে এমনটাই মনে করা হচ্ছে। এদিনের গণনার প্রবণতা এই রাজ্যে ফের একটি পরিবর্তনের সম্ভাবনা উসকে দিয়েছে। এদিনের ফল রাজ্যের শাসনকে ঘিরে না হলেও শক্তির ভরকেন্দ্রের বড় পরিবর্তন তো ঘটেছেই।
এর আগে বাংলায় কংগ্রেস শাসনের অবসান ঘটিয়ে বামেরা ক্ষমতায় এসেছিলেন কৃষক আন্দোলনের মাধ্যমে। জমিদার, জোতদারদের হাত থেকে গরীব মানুষের মুক্তির প্রতিশ্রুতিতে। তারপর ২০১১ সালে রাজ্যে তিন দশকের বাম জমানার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। তাঁরও সাফল্য এসেছিল সিঙ্গুরের জমনি আন্দোলনের মারফতই। কিন্তু এই প্রথমবার, এই রাজ্যে রাজনৈতিক শক্তি বদল ঘটল ধর্মের ভিত্তিতে।
২০১৪ সালে বাংলায় বিজেপির ১৪ শতাংশ ভোট বেড়েছিল। সেই ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছিল বাংলার হিন্দু ভোটের ৪০ শতাংশ, বামেরা পেয়েছিল ২৯ শতাংশ। সেখানে বিজেপির জুটেছিল মাত্র ২১ শতাংশ। অর্থাত সেই বারের সাফল্য ছিল শুধুই মোদী ঝড়ের ফল। তারপর থেকে গত পাঁচ বছরে বিজেপি খুব সুকৌশলে হিন্দু ভোটকে নিজেদের দিকে টেনেছে। আর সেই মোদীর পক্ষের ভোট ও হিন্দুত্ব ভোটকে একত্রিত করেই এদিন চমকপ্রদ দাপট দেখালো পদ্ম শিবির।