৩৭০-৪০০ খ্রিস্টাব্দের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কথা। সব মহিলারা তখন সংসার আর সন্তান সামলাতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এক অসামান্যা সুন্দরী মেয়ে সাদা পোশাক পরে দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান বিষয়ে বলে বেড়াতেন রাস্তায় রাস্তায়। শত শত লোক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত তার বক্তৃতা। তিনি হাইপেশিয়া। ইতিহাস স্বীকৃত প্রথম মহিলা গণিতঙ্গ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং আলেকজান্দ্রিয়ান লাইব্রেরির গবেষক, যার মৃত্যুর পর মিশরের জ্ঞানের আলো নিভে গিয়েছিল প্রায় হাজার বছরের জন্য।
হাইপেশিয়া গণিত শেখাতেন। চেষ্টা করতেন বিষয়ের বাস্তব প্রয়োগ বের করা এবং সেগুলো সহজভাবে বোঝানো। এছাড়া তিনি জল নিষ্কাশন, জলের স্তর পরিমাপ যন্ত্র এবং তারা, গ্রহ ও সূর্যের অবস্থান পরিমাপের জন্য অ্যাস্ট্রোলোব তৈরি করেছিলেন। তরলের ঘনত্ব মাপের জন্য তামার তৈরি একটি হাইড্রোমিটারও তৈরি করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রত্যকের মুক্ত চিন্তা করার অধিকার রয়েছে।
তখনকার আলেকজান্দ্রিয়া খ্রিস্টান ও ইহুদি দুটি ধর্মেরই সমান অনুসারী থাকলেও, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে খ্রিস্টানদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তারা আলেকজান্দ্রিয়াকে সম্পূর্ণ চার্চের অধীনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলো। অসংখ্য ইহুদিকে শহর থেকে তাড়িয়ে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
শহরের গভর্নর অরিস্টিস নিজে খ্রিস্টান হয়েও তখন খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের ভেতর সমঝোতা করানোর জন্য ইহুদিদের পক্ষ নিলে চার্চের বিশপ সেরিল এবং শহরের অন্যান্য খ্রিস্টানরা চরম ক্ষেপে ওঠে। অরিস্টিস পরবর্তীতে খুন হন। হাইপেশিয়ার সঙ্গে অরিস্টিসের বন্ধুত্ব ছিল। রাজনৈতিক নানা ব্যপারে অরিস্টিস তার সাথে আলোচনা করতেন। এই সম্পর্কই হাইপেশিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
হাইপেশিয়া পুরুষ অধ্যুষিত সমাজে বীরদর্পে বিচরণ করে এবং প্রকাশ্যে নিওপ্লেটনিজম ও প্যাগানিজম নিয়ে আলোচনা করেন, বক্তৃতায় নির্ভীকভাবে খ্রিস্টধর্মের অসারতা তুলে ধরেন, চিন্তার স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন এবং প্রত্যেককে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার জন্য উৎসাহ দেন- হাইপেশিয়ার জনপ্রিয়তা স্বাভাবিকভাবেই চার্চের সুনামের পরিপন্থী হয়ে ওঠে। তিনি বিশপদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। সিরিল খ্রিষ্টানদের মধ্যে গুজব ছড়ায় যে, হাইপেশিয়াই অরিস্টিসকে কুবুদ্ধি দিচ্ছে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য। তিনি অরিস্টিসকে জাদু করেছেন। তিনি ডাইনি ও চার্চের শত্রু। গুজ অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
৪১৫ সালের এক দুপুরে হাইপেশিয়া যখন লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পিটারের নেতৃত্বে একদল ধর্মান্ধ হাইপেশিয়াকে তার ঘোড়ার গাড়ি থেকে টেনে হিচড়ে বের করে, তাকে বিবস্ত্র করে টানতে টানতে রাস্তায় নিয়ে আসে। ভাঙ্গা টাইলস এবং শামুকের খোলস দিয়ে খুবলে খুবলে তার মাংস ছিড়ে ফেলে তাকে হত্যা করে। এরপর তারা ক্ষত বিক্ষত হাইপেশিয়াকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে।
এভাবেই শেষ প্রথম মহিলা গণিতবিদ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানীর জীবন। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর কয়েক দিন পরই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়, সঙ্গে হাইপেশিয়ার সব কাজও। এরপর আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী, জাদুঘর এবং স্বর্ণালী সভ্যতার ইতিহাস ফিরে পেতে কয়েক হাজার বছর লেগেছিল।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী রাফায়েল হাইপেশিয়াকে খুঁজে বের করেন এবং শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেন ভ্যাটিকানের অ্যাপোস্টোলিক প্যালেস -এর দেওয়ালে ফ্রেস্কো এঁকে। ফ্রেস্কোগুলি স্ট্যানজে ডি রাফায়েলো নামে পরিচিত। স্কুল অফ এথেন্স সেই ফ্রেস্কোগুলির একটি। ছবিটিতে দেখা যায় এক সময়ের গণিতবিদ, দার্শনিক এবং শাস্ত্রীয় পুরাতাত্ত্বিকরা একে অপরের কাছ থেকে তাদের ধারণা এবং জ্ঞান বিনিময় করছেন। যদিও তারা সকলে বিভিন্ন সময়ে বসবাস করেছেন, কিন্তু ছবিতে তাঁরা এক ছাদের নিচে। প্লেটো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, পিথাগোরাসদের ঠিক মাঝখানে হাইপেশিয়া।
চার্চের ফাদার সেটি দেখতে এসে রাফায়েলকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘মাঝখানের এই সুন্দরী মহিলাটি কে”? রাফায়েল জানান, হাইপেশিয়া। ফাদার তখনই হাইপেশিয়াকে ছবি থেকে সরিয়ে ফেলতে বলেন। কিন্তু রাফায়েলের শিল্পী মন তাতে সায় দেয় নি। তিনি হাইপেশিয়াকে ছবিটি থেকে সম্পূর্ণ না মুছে মাঝখান থেকে সরিয়ে বাঁ দিকে বসিয়ে দেন। তার গায়ের রঙ অন্যান্য গ্রিক-আলেকজান্দ্রিয় মহিলাদের তুলনায় অনেক হালকা করে দেন। এভাবে রাফায়েল হাইপেশিয়াকে পুনরূজ্জীবিত করেন এবং ইতিহাসের সবচেয়ে অসাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে তাকে স্থান দিয়ে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু তাকে ফিরিয়ে দেন।