
আপনি যখন পরের বার কোনও বড় মন্দিরে যাবেন, তখন লক্ষ্য করুন - সেখানে প্রধান দরজা থেকে গর্ভগৃহ পর্যন্ত, সবকিছুই মানুষের শরীরের আকারে নকশা করা। "দেহো দেবালয়ঃ প্রোক্তঃ" সংস্কৃতের একটি শ্লোক। এর অর্থ "শরীরকে মন্দির বলা হয়েছে।" শরীরই মন্দির মানে শরীর মন্দিরের মতোই পবিত্র এবং পূজনীয়। কারণ শরীরের ভিতরে পরমাত্মা আত্মার রূপে বিরাজ করেন। উপনিষদে বলা হয়েছে, মানবদেহ ঈশ্বরের বাসস্থান মন্দিরের মতোই। অথবা, মন্দির প্রাঙ্গণও শরীরের মতোই তৈরি। শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ঐশ্বরিক শক্তিতে পরিপূর্ণ এবং তাকে সম্মান করা উচিত।
তাহলে মন্দিরের নকশা কীভাবে শরীরের মতো, এই মজার বিষয়টি এবার দেখা যাক। এই শরীর পর্যবেক্ষণ করে যোগীরা এর মধ্যে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, আনাহত, বিশুদ্ধি, আজ্ঞা, সহস্রার - এই সাতটি চক্র বা কেন্দ্র চিহ্নিত করেছেন। এই সাতটি কেন্দ্র সাতটি দরজার মতো, যা ভেতরে জ্বলন্ত পরমাত্মার দর্শনের পথ করে দেয়। এই সাতটি কেন্দ্রের মধ্যে তিনটি কেন্দ্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে একটি সবচেয়ে প্রধান। এই অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে মন্দিরেও সাত দরজা, তিন দরজা, এক দরজা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
একজন পুরুষ তার হাত দুটি বুকের উপর রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে কল্পনা করুন। এখন মন্দিরের গর্ভগৃহের উপরে উঠে যাওয়া প্রধান গম্বুজটি, যাকে বলা হয় 'বিমান', সেটি ব্যক্তির মাথার প্রতীক। এটি ঐশ্বরিক উপস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করে এবং মন্দিরের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। মাথা যেমন চিন্তাভাবনা এবং বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি বিমানটি সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক সারকে ধারণ করে। শক্তিকে স্বর্গ থেকে মন্দিরে এবং ভক্তের মন ও আত্মায় প্রবাহিত করে।
মাথা থেকে নীচে নামলে মহল মণ্ডপ বা মহা সভাগৃহ। এটি মানবদেহের বুকের অংশের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। এই অঞ্চল হৃদয় এবং ফুসফুসের প্রতীক। যেখানে প্রধান শক্তি এবং আধ্যাত্মিক সার মিলিত হয়। মণ্ডপ ভক্তদের সম্মিলিত শক্তি এবং ভক্তি অনুভব করার জন্য একত্রিত হওয়ার স্থান হিসেবে কাজ করে। এটি শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক পুষ্টির স্থান। যেখানে মন্দিরের হৃদয় জীবন এবং চৈতন্যের প্রবাহের সাথে স্পন্দিত হয়, বুকের অঞ্চল যেমন মানবদেহে রক্ত এবং বাতাসের প্রবাহের কেন্দ্র।
মেরুদণ্ডের প্রতিনিধি হিসেবে একটি ধ্বজস্তম্ভ। ঈশ্বরের সান্নিধ্যে সৃষ্ট ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার প্রতীক হিসেবে শিখরে একটি, তিন, পাঁচ, সাত কলসের ব্যবস্থা। মন্দিরের চারপাশে দেয়ালে ক্রমান্বয়ে ভৌতিক, ঐশ্বরিক, আধ্যাত্মিক ভাস্কর্য থাকে। অন্তরঙ্গে চলা সাধুভক্তদের সংগ্রাম এবং সৎ শক্তির বিজয়ের গল্পের ভাস্কর্য। চৌষট্টি বিদ্যার বিভিন্ন চিহ্ন, এই সবই মানবদেহের অভ্যন্তরীণ গঠনের সাথে মিল রাখে।
স্তম্ভের সংখ্যা চব্বিশ, ছত্রিশ, চৌষট্টি, ছিয়ানব্বই, একশ আট, এক হাজার আট - এইভাবে সৃষ্টির বিকাশে থাকা নীতির প্রতিনিধি হিসেবে এসেছে। পা-ই হল প্রধান দরজা। শোয়া অবস্থায় পা যেমন উঁচুতে দেখায়, তেমনি প্রধান দরজার গম্বুজ উঁচু হয়। দাঁড়ানো অবস্থায় যৌনাঙ্গ যেমন থাকে, তেমনি ধ্বজস্তম্ভ থাকে। পেটই হল বলিপীঠ, হৃদয় হল নবরঙ্গ, কণ্ঠ হল সুকনাসি, মাথা হল গর্ভগৃহ, ভ্রূমধ্যের আজ্ঞাচক্র স্থানই হল মূল পীঠ। লম্ব রূপে দেখলে পা হল নিধিকুম্ভ, নালী হল মোড়, ভিত্তি হল উরু, কটি-উদর হল দেয়াল। কাঁধ হল বল্লভী, হাত হল প্রাকার, জিহ্বা হল ঘণ্টা, হৃদয় হল প্রতিমা, কণ্ঠ হল বিমান, মাথা হল শিখর, ব্রহ্মরন্ধ্র হল কলস।
কোষের দৃষ্টিকোণ থেকে, বাইরের প্রাকার হল অন্নময়, ভেতরের প্রদক্ষিণ পথ হল প্রাণময়, নবরঙ্গের পরিধি হল মনোময়, অন্তঃপ্রদক্ষিণ পথ হল বিজ্ঞানময় এবং গর্ভগৃহ হল আনন্দময় কোষ। এই কোষগুলি মানব শরীরেও আছে।
এইভাবে মন্দির শুধু একটি ইমারত নয়। এটি সনাতন ভারতের বিজ্ঞানী ঋষিদের তপস্যার ফল। "শরীরই তীর্থক্ষেত্র" এই সনাতন ধর্মের অনাদি কল্পনাকে বাস্তব রূপ দিতে পূর্বপুরুষরা এটি তৈরি করেছিলেন। জীবনকে ঈশ্বর বানানোর মহান সংকল্প মন্দিরের মধ্যে থাকে। শরীরই ঈশ্বরের বাসস্থান এই কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়।