
সালটা ছিল ১৯১৯। জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ডের কারণে 'কুখ্যাত' হয়েছিলেন জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ১০০০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ১৫০০ জন আহত হন। এই ঘটনায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। উইনস্টন চার্চিল এই ঘটনাকে 'একটি ভয়াবহ ঘটনা' বলে নিন্দা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, 'একটি ঘটনা যা একক ও ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতার মধ্যে দাঁড়িয়েছিল।' অন্যদিকে বিখ্যাত কবি ও উঔপন্যাসিক রুডইয়ার্ড কিপলিং জেনারেল ডায়ারকে 'ভারতের রক্ষাকারী ব্যক্তি' বলে প্রশংসা করেছিলেন। কিপলিং 'জেনারেল ডায়ার তহবিল' নামে সেই সময় একটি ফান্ড তৈরি করেছিলেন। তিনি প্রায় ২৬০০০ পাউন্ড সংগ্রহ করেছিলেন। ডায়ার যখন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর রক্তাক্ত হাতে ব্রিটেনে ফিরেছিলেন সেই সময় তিনি সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ডায়ারের হাতে তুলে দেন।
জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ার ও তাঁর কর্মকাণ্ডকে পঞ্জাবের গভর্নর স্যার মাইকেল ও'ডোয়ার ও লর্ড চেমসফোর্ডের নেতৃত্বে ভারতের ঔপনিবেশিক সরকার সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিল। এতো গেল ইংরেজদের কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে জেনারেল ডায়ারের 'অন্ধভক্ত' ভারতেও ছিল। যারা ডায়ারের এই ভারতীয়দের নৃশংসভাবে হত্যা করাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিল। সেই 'অন্ধভক্ত'-র তালিকা নিছকই ছোট নয়, বেশ লম্বা। তালিকায় সবথেকে ওপরে থাকা নামটি হল সেই সময়ের লাহোরের বাহাদুর কুঞ্জবিহারি থাপর। স্বর্ণমন্দির ব্যবস্থাপনা (SGPC-এর পূর্বসূরী) ডায়ারকে একটি কৃপাণ (তলোয়ার) এবং একটি শিরোপা (পাগড়ি) উপহার দেয়। কুঞ্জবিহারী থাপার, উমর হায়াত খান, চৌধুরী গজ্জন সিং এবং রায় বাহাদুর লাল চাঁদ সেই সময়ে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পুরষ্কার স্বরূপ ডায়ারকে ১.৭৫ লক্ষ টাকা দিয়েছিল।
১৯১৯ সাল, অবিভক্ত ভারতবর্ষ। থাপররা ছিল উঠতি ধনী পরিবার। ব্রিটিশদের আনুগত্য দেখিয়ে প্রচুর টাকা করেছিল। থাপররা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা বাহিনীর কমিশন এজেন্ট হিসেবে ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠেছিল। এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছিল। একদিকে ব্রিটিশ আনুগত্য লাভ, অর্থদিকে অর্থ লাভ। ব্যবসার রাশ যাতে তাদের হাতে থাকে তারজন্য ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের খুশি করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করেছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য কুঞ্জবিহারী থাপরকে সেই সময়ের সবথেকে সেরা উপাধিও দিয়েছিল ব্রিটিশ প্রভুরা।
কুঞ্জবিহারী থাপরের তিন পুত্র ও পাঁচ কন্যা। তারা ছেলেরা- দয়ারাম থাপর, প্রেমনাথ থাপর ও প্রাণনাথ থাপর।
কুঞ্জবিহারী থাপরের বড় ছেলে দয়ারাম থাপর। তিনি এডিনবার্গের মেডিক্যাল ছাত্র। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসেবক চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীকালে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর চিকিৎসা পরিষেবার মহাপরিচালক হন। তাঁর এক পুত্র রমেশ থাপর। দুই কন্যা বিমলা আর রোমিলা। ঠিকই ধরেছেন পাঠক, রোমিলা থাপর হলেন JNU-র 'বিশিষ্ট অধ্যাপক এমেরিটার্স'।
লাহোরে জন্ম রমেশ থাপরের। পড়াশুনার জন্য পাঠানো হয়েছিল ইংল্যান্ডে। তিনি একজন ফ্যাশানেবল সমাজতান্ত্রিক হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন। তিনি আমৃত্যু ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সদস্য ছিলেন। তিনি মার্কসবাদী আদর্শের একজন প্রচারকও ছিলেন। রমেশ একটি মাসিক পত্রিকা চালাতেন। তারজন্য সেমিনার করছেন। এটি ছিল স্থিতিশীল রাজস্ব মডেল। অনুমান করা হয় পত্রিকা ও সেমিনারের সমস্ত বিজ্ঞাপন সরকারি রাজস্ব থেকেই আসত। বিক্রি করা হত সরকারি গ্রন্থাগার আর সরকারি প্রতিষ্ঠানে। সমাজতান্ত্রিক ও সামাজিকভাবে প্রগতিশীল নেহরুর নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেও রমেশ থাপর ছিলেন সক্রিয়। তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের ঘাঁটি সেই সময়েই মুম্বই থেকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন। সরকার আনুগত্যের ফল হিসেবে যথেষ্ট কম টাকায় তাঁর জন্য সম্পত্তি বরাদ্দ করেছিল। ১৯৬০ -এর দশকের শেষের দিকে রমেশ ও রাজ ছিলেন বুদ্ধিজীবী অভিজাত। কেন্দ্রীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন রমেশ। নেহরুর মৃত্যুর পরই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে শুরু করেন তিনি। রমেশ থাপারের দুই সন্তান মালবিকা (মালা) সিং ও বাল্কিক থাপার।
বাল্মিক থাপর অভিনেতা শশী কাপুরের মেয়ে সঞ্জনা কাপুরকে বিয়ে করেছিলেন এবং বর্তমানে তিনি ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞদের একজন। বাল্মিক বিবিসি, অ্যানিমেল প্ল্যানেট, ডিসকভারি এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক -এর মত চ্যানেলের জন্য তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন।
মালবিকা থাপর তেজবীর 'জুগনু' সিংকে বিয়ে করেছিলেন, যিনি নয়াদিল্লির সবচেয়ে বিশিষ্ট পরিবারের (নীচে দেখুন) ছেলে ছিলেন যারা কলকাতা থেকে এখানে স্থানান্তরিত হওয়ার পরে নতুন রাজধানী তৈরি করেছিলেন।
প্রাণনাথ থাপর ছিলেন লাহোরের দিওয়ান বাহাদুর কুঞ্জবিহারী থাপরের কনিষ্ঠপুত্র। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাসে,প্রাণনাথ থাপর গৌতম সেহগলের বোন বিমলা বশিরাম সেহগলকে বিয়ে করেন। গৌতমের স্ত্রী নয়নতারা সেহগল (পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য বিখ্যাত) ছিলেন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের কন্যা এবং জওহরলাল নেহরুর ভাগ্নী। জেনারেল প্রাণনাথ থাপর ছিলেন একমাত্র ভারতীয় সেনাপ্রধান যিনি (১৯৬২ সালে চিনের বিরুদ্ধে) যুদ্ধে হেরেছিলেন। জেনারেল কে.এস. থিমাইয়া অবসর গ্রহণের সময় লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস.পি.পি. থোরাটকে তার উত্তরসূরি হিসেবে সুপারিশ করেন। তবে, তা বাতিল করে প্রাণনাথ থাপরকে নির্বাচন করা হয়। ১৯৬২ সালের পরাজয়ে প্রাণনাথ থাপরের ভূমিকা কীভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে বাদ পড়ে যায় তা আশ্চর্যজনক। পরাজয়ের পর তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন । পদত্য়াগের পদ্ধতিও ছিল অপমানজনক। জেনারেল থাপর এবং শ্রীমতি বিমলা থাপররে চার সন্তান । তাঁদের সবচেয়ে ছোট সন্তান বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপার, যিনি দ্য ওয়্যারে লেখেন।
থাপর পরিবারের পর এবার আসি সিং পরিবারে।
শাহপুর জেলা (বর্তমানে পাকিস্তান) খুশাবের হুদালি গ্রামের বাসিন্দা সুজন সিং। তাঁর পুত্র শোভা সিং। তিনি ছিলেন ১৯২৯ সালে বিধানসভায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার একজন অন্যতম সাক্ষী। তিনি পরবর্তীকালে ভগৎ সিং বটুকেশ্বর দত্তকে চিহ্নিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে শোভা সিং সাক্ষীদেন আদালতে। তাঁর বয়ানের ওপর ভিত্তি করেই ভগৎ সিং, সুখদেব আর রাজগুরুকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ছিল ব্রিটিশ সরকার।
সুমন সিং ও শোভা সিং-ও ছিলেন ব্রিটিশদের অনুগত। ভারতের ভাইসরয় হার্ডিঞ্জ ব্রিটিশ ভারতীয় রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করার পরিকল্পনা করেছিল। সেই পরিকল্পনা রূপায়নের জন্য সুমন সিং আর শোভা সিংকে সিনিয়র গ্রেড ঠিকাদার ঘোষণা করেছিল। লুটিয়ানদের দিল্লি নির্মাণের কাজ এই দুজনের ওপর দেওয়া হয়েছিল। সাউথ ব্লক এবং ওয়ার মেমোরিয়াল আর্চের (বর্তমানে ইন্ডিয়া গেট) জন্য, অশিক্ষিত শোভা সিং-কে একমাত্র নির্মাতা হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। শোভা সিং দিল্লিতে প্রচুর জমি কিনেছিলেন। সেই সময় তিনি দিল্লিতে তিনি প্রতি বর্গগজ জমি মাত্র ২ টাকায় কিনেছিলেন। সেই সময় তাঁকে 'আধি দিল্লিকা মালিক' (অর্ধেক দিল্লির মালিক) বলেই অনেকে ডাকত। ১৯৪৪ সালে শোভা সিং-এর জন্মদিনে তাঁকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়। স্যার শোভ সিং-এর ছোট ভাই সর্দার উজ্জল সিং পরবর্তীকালে সাংসদ হন। তিনি তামিলনাড়ু চেয়ারম্যানও হয়েছিলেন।
স্যার শোভার চার ছেলে ছিল, ভগবন্ত সিং, খুশবন্ত সিং (বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং লেখক), মেজর গুরবকশ এবং দলজিৎ এবং এক মেয়ে, মহিন্দর কৌর।
খুশবন্ত সিং-এর ছেলে রাহুল সিং একজন সাংবাদিক। NDTV বা অন্য কোনও সংবাদ চ্যানেলে তরুণ তেজপাল, তিস্তা সেতলওয়াড় এবং আর.কে. পাচৌরির মতো গুরুতর যৌন/অপরাধী, অপরাধীদের পক্ষে সওয়াল করে থাকেন।
আরও একটি অবাক করা তথ্য, কুঞ্জবিহারী থাপর (জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার সমর্থক-এর নাতনী মালবিকা সিং স্যার শোভা সিং (যাঁর কারণে ভগৎ সিং-এর ফাঁসি হয়েছিল)-এর নাতি তেজবীর সিং-কে বিয়ে করেছিলেন।
থাপর আর সিং- আনুগত্যের একটি সার্কিট। 'সেমিনার ম্যাগাজিন'নামে একটি পত্রিকা চালায়। যার পাবলিসার মালবিকা সিং (রমেশ থাপরের মেয়ে) আর এডিটর তেজবীর সিং (শোভা সিং-এর মেয়ে। এই পত্রিকার মাধ্যমে বর্তমানে তাঁরা কংগ্রেসের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। দুটি পরিবারের সদস্যরা কংগ্রেসকে রক্ষা করার জন্য প্রাণপাত করে। যেমন, করণ থাপার সংবাদ মাধ্যমের মাধ্য়মে গুরুদায়িত্ব পালন করেন। আর রোমিলা থাপর, সর্বোচ্চ স্তরে শিক্ষাকে দূষিত করছেন।
লেখক পরিচিতিঃ সৌরভ চক্রবর্তী
DIC, FRSA, FRAS, CEng (IET এবং IEI), CMgr (MCMI)
উদ্যোক্তা - ভারতীয় GenZদের জন্য বিল্ডিং
ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন, ইউকে এবং বোস্টন ইউনিভার্সিটি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন ছাত্র
সনাতন ও ভারতীয় ইতিহাস প্রেমী, রাজনৈতিক উত্সাহী, পর্যবেক্ষক এবং কলামিস্ট
(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)