রাজ্যে স্মার্ট মিটার বসানোর সিদ্ধান্ত বিতর্কের মুখে, অভিযোগ জানাচ্ছে বহু গ্রাহক

Published : Jun 04, 2025, 05:52 PM IST
Electricity Smart meters

সংক্ষিপ্ত

স্মার্ট মিটার বিদ্যুৎ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, তবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া গ্রাহকদের কাছে কতটা স্বচ্ছ? কতটাই বা সুবিধাজনক? প্রশ্ন মুখে জনসাধারণ।

২০২১ সালের ৯ জুলাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যে স্মার্ট মিটার বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যা ভারতের বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের 'রিভ্যাম রিডিস্ট্রিবিউশন সেক্টর স্কিম' এর অধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল বিদ্যুৎ ব্যবস্থার ডিজিটালাইজেশন, বিদ্যুৎ চুরির প্রতিরোধ, এবং গ্রাহকদের বিদ্যুৎ ব্যবহারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। তবে, স্মার্ট মিটার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া ও তার প্রভাব নিয়ে রাজ্যের গ্রামাঞ্চলগুলিতে ব্যাপক আলোচনা ও বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

স্মার্ট মিটার কী আসলে?

স্মার্ট মিটার হল একটি আধুনিক মিটার, যা ‘প্রিপেইড মোডে’ কাজ করে। অর্থাৎ গ্রাহককে আগে থেকে রিচার্জ করতে হবে, তারপর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন। যেমন পাঁচশো টাকার রিচার্জ করলে, গ্রাহক পাঁচশো টাকারই বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন। যেমনটা আরকী মোবাইলে প্রিপেড সিস্টেমে হয়!

সাধারণ মিটারের সঙ্গে স্মার্ট মিটারের পার্থক্য

* প্রথমত: ডিজিট্যাল মিটারে থাকে রিডিং পদ্ধতি। অর্থাৎ এখন আমাদের বাড়িতে যে ধরনের মিটার লাগানো রয়েছে, তাতে মাসে বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা এসে রিডিং নিয়ে যান। কিন্তু স্মার্ট মিটারের ক্ষেত্রে তেমনটা হবে না। স্মার্ট মিটারে তথ্য সরাসরি যাবে সার্ভারে।

* দ্বিতীয়ত: এই দুই ধরনের মিটারে বিলিং পদ্ধতিতেও ফারাক রয়েছে। ডিজিট্যাল মিটারে পোস্টপেইড বিল আসে। অর্থাৎ গ্রাহক যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করবে, তার ভিত্তিতে বিল আসবে। কিন্তু স্মার্ট মিটারে প্রিপেইড সিস্টেমে বিল আসবে। অর্থাৎ আগে গ্রাহককে রিচার্জ করতে হবে, তার ভিত্তিতে তিনি বিদ্যুৎ খরচ করতে পারবেন।

* তৃতীয়ত: ডিজিট্যাল মিটারের ক্ষেত্রে, কোনও গ্রাহক যদি বিদ্যুৎ বিল মেটাতে অক্ষম হন, তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের পর বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা বাড়ি গিয়ে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। কিন্তু স্মার্ট মিটারের ক্ষেত্রে রিচার্জ শেষ হয়ে গেলেই আপনাআপনি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে।

প্রকল্পের বাস্তবায়ন

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (WBSEDCL) প্রথম ধাপে সরকারি অফিস, পুরসভা, পঞ্চায়েত, শিল্প ও বাণিজ্যিক সংযোগগুলিতে স্মার্ট মিটার বসানোর কাজ শুরু করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ লক্ষ স্মার্ট মিটার বসানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের জন্য রাজ্য সরকার RDSS প্রকল্পের আওতায় ১১.৮৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে, যার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের অংশ ৬০% এবং রাজ্য সরকারের অংশ ৪০%।

এই স্মার্ট মিটারে সুবিধা কী?

১। গ্রাহকদের হাতের মুঠোয় রিডিং

এই মিটারে, গ্রাহক অ্যপ থেকেই মিটার রিডিং দেখে নিতে পারবেন, বুঝতে পারবেন তিনি কতটা বিদ্যুৎ পোড়ালেন। ডেটা ফোনেই আসবে। এক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছে ‘কমিউনিকেশন সিস্টেমটা’ খুব সহজ হবে। বিদ্যুৎ দফতরের এক আধিকারিক গৌতম দত্ত বলেছেন,” বিদ্যুৎ কতটা পোড়ালেন, গ্রাহকের হাতের মুঠোয় থাকবে গোটা তথ্য। সেই বুঝে বিদ্যুৎ খরচ করবেন।”

২। পরিস্থিতি নিজেই বুঝে বিদ্যুৎ খরচ

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিদ্যুৎ সংযোগে যে পরিমাণ লোড দেওয়া হয়, তার থেকে বেশি লোডের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে ফেলছেন গ্রাহক। দফতর থেকে তখন সেই গ্রাহককে সতর্ক করা হয়। কিন্তু স্মার্ট মিটারে , গ্রাহক গ্রাফিক্যালি বুঝতে পারবেন, কতটা লোড নেওয়া রয়েছে, কতটা খরচ হচ্ছে। ইচ্ছা করলে, গ্রাহক নিজেই লোড কমিয়ে নিতে পারবেন, বাড়িয়েও নিতে পারবেন।

৩। পোস্ট পেইড বিল ও অতিরিক্ত ছাড়

বিদ্যুৎ দফতরের আধিকারিক সূত্রে খবর, প্রাথমিকভাবে মিটারের বিল আসবে পোস্ট পেইড মোডেই। আগেও গ্রাহক যেমন বিদ্যুতের বিল জমা দিতেন, এখনও তেমনই করবেন। প্রি পেইড যখন হবে, তখন কিছুটা পরিবর্তন হবে। আধিকারিক গৌতম দত্তের কথায়, ” ধরুন আপনার বিল আসে ২০০ টাকা, এটাই যখন প্রি পেইডে একেবারে রিচার্জ করছেন, তখন তিন শতাংশ ছাড় পাবেন। এখনকার ক্ষেত্রে একবারে বিদ্যুতের বিল মেটালে এক শতাংশ ছাড় পাওয়া যায়।”

৪। অগ্রিম মেটাতেও লাগবে না EMI

এই স্মার্ট মিটারে টাকা যদি কিছু বাকি থাকে, তাহলে তিন বারের ধাপে ভাগ হবে। ধরুন কোনও গ্রাহকের ৬০০০টাকা বাকি রয়েছে, তাহলে তিন মাসে ২ হাজার করে দিতে হবে। তবে এর জন্য কোনও ইএমআই দিতে লাগবে না। সিকিউরিটি ফি যেটা জমা থাকে, সেটাও অ্যাপে ওয়ালেটে চলে আসবে। আমাদের ৬ শতাংশ করে সিকিউরিটি থাকে। সিকিউরিটি মানে, গ্রাহকের তিন মাসের বিল একটা ‘অ্যাভারেজ’ ধরে অগ্রিম রাখতে হয়।

৫। কাস্টমার কেয়ারের সুবিধা

স্মার্ট মিটারে এখন বিল জমা দেওয়া পোস্টপেইড মোডেই চলবে, প্রিপেইড মোডে হলে অ্যাপ দেওয়া হবে গ্রাহকদের। তখনই গ্রাহককে সে বিষয়ে বোঝানো হবে। সমস্যা হলে কাস্টোমার কেয়ার নম্বরে যোগাযোগ করলেই সমস্যা মিটবে। আলাদা টিমও রয়েছে এর জন্য।

তবে গ্রাহকদের অভিযোগ কোথায়?

গ্রাহকদের মূলত বক্তব্য, স্মার্ট মিটার কী, তা তাঁদেরকে সেভাবে না বুঝিয়েই কার্যত জোর করে বাড়িতে বসানো হচ্ছে। বর্ধমান, আসানসোল. দুর্গাপুরের মতো একাধিক জায়গায় বিদ্যুৎ দফতরে গ্রাহকরা গিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন স্মার্ট মিটার খুলে পুরোনো মিটার লাগিয়ে দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রেও বিদ্যুৎ দফতরের স্টেশন ম্যানেজার কার্যত অসহায়।

১। আগাম না জানিয়েই মিটার পরিবর্তন

গ্রাহকদের অভিযোগ, হঠাৎ করেই বিদ্যুৎ দফতরের কর্মীরা আসছেন, আগাম কোনও খবর ছাড়াই মত না নিয়েই মিটার পরিবর্তন করে দিয়ে যাচ্ছেন। বর্ধমানের এক গ্রাহক বলেন, “আমি বাড়িতে ছিলাম না, আমার স্ত্রী-মেয়ে ছিল। হঠাৎই এসেই মিটার বদলে দিয়ে চলে গেল। আমি বাড়ি এসে খবর পাই। আমার প্রতিবেশীরা কেউই মিটার বদলাতে চাননি।”

২। জরিমানার ভয়

গ্রাহকদের অভিযোগ, মিটার না বসালে ফাইন হয়ে যাওয়ারও ভয় দেখানো হচ্ছে। কিন্তু এই মিটার কীভাবে কাজ করবে, কীভাবে রিচার্জ করা হবে, সেই সংক্রান্ত কোনও অ্যাপ কিছুই ফোনে ডাউনলোড করিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে একেবারেই অন্ধকারে গ্রাহকরা। এক গ্রাহকের কথায়, “আমরা কীভাবে রিচার্জ করব, সেটাও জানানো হয়নি, মিটারটা বসিয়ে দিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমরা পুরনো মিটারের নম্বর নিয়ে বিদ্যুৎ অফিসে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেখান থেকেও পরিস্কারভাবে কিছু বলা হচ্ছে না।”

৩। বিদ্যুতের বিল বেশি আসছে

গ্রাহকদের অভিযোগ, পুরনো মিটারের বদলে নতুন মিটারে বিদ্যুতের বিল বেশি আসছে। বর্ধমানেরই বাসিন্দা অশোক কর্মকার ট্রেনে হকারি করেন। তাঁর বাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে স্মার্ট মিটার। তাঁর অভিযোগ, “আমার ভীষণই অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের বিল বেশি আসছে। আমার ঘরে ফ্যান রয়েছে একটা, আর একটা টিভি রয়েছে। ফ্রিজও নেই। যেখানে আগে একমাসে ৫০০-৬০০ টাকা বিল আসত, সেখানে এখন বিল ৮০০-৯০০টাকা আসছে। পুরনো মিটারের রিডিং না দিয়েই চলে গিয়েছে। নতুন মিটারে এখনই এই বিল এসেছে।”

উল্লেখ্য, এখনও পর্যন্ত কোনও বিল আসেনি গ্রাহকদের কাছে। তবে গ্রাহকদের অভিযোগ, নতুন মিটারে রিডিং বেশি পুড়ছে। ফলে বিল স্বাভাবিকভাবেই বেশি হবে।

৪। অ্যাপ নিয়ে অস্বচ্ছতা

গ্রাহকরা এই গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে ভীষণভাবে অন্ধকারে। বর্ধমান, মেদিনীপুরের বেশ কয়েকজনের বাড়িতে স্মার্ট মিটার বসানো হয়েছে। কিন্তু কীভাবে এই মিটার কাজ করবে, কীভাবে রিচার্জই বা করবেন কিছুই জানানো হয়নি তাদের। এক গ্রাহকের কথায়, “শুধু মিটারটা বসিয়ে দিয়েই চলে গেল। কিচ্ছু বোঝায়নি ওরা। কীভাবে কাজ করবে, টাকাই বা ভরবো কীভাবে, তা তো জানি না। কোনও অ্যাপও দেয়নি।”

৫। বিদ্যুৎ দফতরের অসহযোগিতার অভিযোগ

প্রিপেইড সিস্টেমে টাকা জমা দেবেন কীভাবে? কোনও সমস্যা হলে, গ্রাহকরা জানাবেন কোথায়? বিদ্যুৎ দফতরে গেলে মিলছে না উত্তর। একাধিক জেলায় বিদ্যুৎ দফতরে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন গ্রাহকরা। বর্ধমানের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাকারমাঠের এক গ্রাহক বলেন, “আমরা বিদ্যুৎ অফিসে গিয়েছিলাম। স্যর বললেন, আমরা কিছু জানি না। আমাদের উপরতলার আধিকারিকরা জানেন। আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। যা বলা হচ্ছে, তাই করছি।” উল্লেখ্য, ওই এলাকার ৩২টি বাড়িতে মিটার পাল্টেছে, প্রত্যেকেই একই অভিযোগ। এমনকি গ্রাহকদের এও অভিযোগ, বিদ্যুৎ দফতর থেকে লোক এসে তাঁদের সমস্যা মেটানোর কোনও আশ্বাসও দিচ্ছেন না।

স্মার্ট মিটার নিয়ে দ্বিমত ও প্রতিবাদ

‘অল বেঙ্গল ইলেক্ট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর জেনারেল সেক্রেটারি সুব্রত বিশ্বাসও এ বিষয়ে অসুবিধা নিয়ে বেশ কিছু কথা বলেন, “প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষেত্রে কি গ্রাহকরা আদৌ মেসেজ দেখে রিচার্জ করতে পারবেন? এই স্মার্ট মিটার ডাটা ট্র্যান্সমিশন সিস্টেমের মাধ্যমে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের কন্ট্রোলে পরিবাহিত হবে। যে কেউ ভারতের যে কোনও জায়গায় বসে সফটওয়্যারকে হ্যাক করে মিটারের রিডিংকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।” এমন আসঅহংকার কোথাও তুলে ধরেছেন তিনি।

এই স্মার্ট মিটারের প্রতিবাদে সিটু-র নেতৃত্বে আন্দোলনে নেমেছেন অনেকেই। প্রতিবাদে আছে ‘অল বেঙ্গল ইলেক্ট্রিসিটি কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (ABECA)। ২০২২ সালে কেন্দ্রের সরকার একটি নতুন স্কিম নিয়ে আসে, দেশের বিদ্যুৎ বণ্টন পরিষেবাকে রিফর্ম করার জন্য। ‘রিভ্যাম রিডিস্ট্রিবিউশন সেক্টর স্কিম’ অর্থাৎ RDSS। ABECA-র সেক্রেটারি সুব্রত বিশ্বাসের মতে অসুবিধা একাধিক জায়গায়। তিনি বলেন, “অবাকের বিষয়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের আগেই ২০২১ সালে ৯ জুলাই স্মার্ট মিটার বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু এতে বিদ্যুৎ পরিষেবা সম্পূর্ণভাবে বেসরকারিকরণের প্রয়াস চলছে।”

PREV
Read more Articles on
click me!

Recommended Stories

Google Gemini: কাজের চাপ কমাতে চান? গুগল ওয়ার্কস্পেসে জেমিনি ব্যবহার করুন এইভাবে
নেটফ্লিক্সে এবার বড় পরিবর্তন, মোবাইল অ্যাপে আর পাওয়া যাবে না এই ফিচার