আশিস মণ্ডল, সিউড়ি: ছ' বছরের ছেলের অস্ত্রোপচার হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই অস্ত্রোপচারের সময় অপারেশন থিয়েটারের বাইরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন মা। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন শিশুটির বাবা। অস্ত্রোপচারের শেষে অবশ্য হাসিমুখে বেরিয়ে এসে চিকিৎসক যা বললেন, তাতে নিজেদের ছেলের কীর্তিতে নিজেরাই থ বীরভূমের সিউড়ির বাসিন্দা সৌগত চক্রবর্তী এবং তাঁর স্ত্রী সৌমী চক্রবর্তী! কারণ চিকিৎসক তাঁদের জানালেন, গোটা অস্ত্রোপচারের সময় ভয় ভীতি দূরে থাক, ডাক্তার এবং নার্সদের একটানা গান শুনিয়েছে ছ' বছরের অনন্য। আর অপারেশন টেবিলে ছোট্ট অনন্যর গান গাওয়ার সেই ভিডিও-ই এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল।
অনন্য চক্রবর্তী। বয়স মাত্র ছ' বছর। সিউড়ি শহরের পাইকপাড়ার বাসিন্দা অনন্য মাস কয়েক ধরে ফাইমোসিস রোগে ভুগছিল। চিকিৎসককে দেখানোও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার ছাড়া রোগ নিরাময় সম্ভব নয় বলেই জানিয়ে দেন চিকিৎসক দীপক কুমার মুখোপাধ্যায়। ছেলে যাতে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে, তার জন্য চিকিৎসকের পরামর্শেই ভরসা রাখেন অনন্যর বাবা- মা। সেই মতোই চারদিন আগে সিউড়ির একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অনন্যকে। সেখানেই তার অস্ত্রোপচার হয়।
সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন না করে শরীরের একটি অংশ অবশ করে শিশুটির অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচার শুরু হতেই শিশুটির ভয় কাটাতে সে গান জানে কি না জিজ্ঞেস করেন চিকিৎসক। একটুও না ঘাবড়ে অনন্য গান গাইতে শুরু করে। তখন তার চোখও ঢেকে রাখা হয়েছিল। প্রথমেই সে 'টিপটাপ টুপটাপ বৃষ্টি, সেই থেকে পড়ছে তো পড়ছে গানটি ধরে।' খুদে রোগীর গলা ছেড়ে গান আর মনের জোরে ততক্ষণে অপারেশন থিয়েটারের গুরুগম্ভীর পরিবেশও বদলে গিয়েছে। অনন্যর এই কীর্তি ক্যামেরাবন্দি করতে ভোলেননি অপারেশন থিয়েটারে থাকা চিকিৎসক এবং নার্সরা। সেই ভিডিও-ই ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
একটি গান শেষ হতেই চিকিৎসকের কথায় আরও একটি গান গায় ছোট্ট অনন্য। ডাক্তার কাকুর কথা শুনে জাতীয় সংগীতও গেয়ে শোনায় সে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর সফলভাবেই শেষ হয় অনন্যর অস্ত্রোপচার। অনন্যর কীর্তিতে অবাক চিকিৎসক বাইরে এসে শিশুটির বাবা- মাকে বলেন, 'আপনাদের ছেলে তো বিরল কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে!'
আরও পড়ুন- সাত দিনে আড়াই কোটি ভিউ, পাঁচ বছরের ওলির গান ইউটিউবে ভাইরাল, দেখুন ভিডিও
অস্ত্রোপচারের পরে নার্সিং হোম থেকে ছুটি পেয়ে আপাতত বাড়িতেই রয়েছে অনন্য। অস্ত্রোপচারের সময় একটু সাহসী হয়েই সে গানগুলি গেয়েছে বলেই অকপটে স্বীকার করছে সিউড়ির সরোজিনীদেবী শিশু মন্দিরের কেজি থ্রিয়ের পড়ুয়া অনন্য। বেশ ভাবলেশহীনভাবেই সে জানাচ্ছে ' ডাক্তারবাবু বললেন, তুমি কি গান শেখো? আমি হ্যাঁ বলেই দু'টি গান শোনালাম।' শুধু অপারেশন টেবিলেই নয়, বাড়িতে বসেও সেই গান শুনিয়েছে অনন্য। স্কুলে যে মাতৃবন্দনা হয়, তাও চিকিৎসকে শুনিয়েছে বলে জানায় অনন্য। যদিও বিশ্রামে থাকায় এখন বাড়ি থেকে কোথাও বেরোতে পারছে না সে। আর এতেই কিছুটা মন খারাপ অনন্যর। শিশুটির বাবা পেশায় স্কুল শিক্ষক সৌগত চক্রবর্তীর কথায়, 'আমরা যখন অপারেশন থিয়েটারের বাইরে বসে কান্নাকাটি করছি, তখন চিকিৎসক বেরিয়ে বললেন, 'আপনার ছেলে তো ইতিহাস তৈরি করে দিয়েছে।'
অন্যদিকে চিকিৎসক দীপক কুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, 'এধরনের অস্ত্রপচারের ক্ষেত্রে রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করেই অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু ও ছোট বলেই আমরা শুধু যে জায়গায় অস্ত্রপচার করা হবে, সেখানটাই অবশ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই শিশুটির দেখলাম অসীম সাহস। ওকে গান করতে বলার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি গান শোনাল। ও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠছে।'
বাইরে মেঘ, বৃষ্টি আর রোদের লুকোচুরি খেলা চলছে। বাড়িতে বসে জানলার দিকে তাই আপন মনেই অনন্য গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠছে. ' ‘……চুপচাপ ঘরে বসে থাকতে মনটা কেমন যেন করছে।'