আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস, সেদিনই আবার ভোট। তাও আবার এ দিনের ভোট এমন দু' জনের সম্মানের লড়াই, যাঁদের সম্পর্কের মধ্যে মা-মেয়ের শ্রদ্ধা, স্নেহ, ভালবাসার ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন রাজ্যবাসী। কিন্তু রাজনীতি সম্পর্কের ধার ধারে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় অনেক সম্পর্কের হিসেব নিকেশ। তাই একদা প্রশাসনিক পদে থেকেও যাঁকে জঙ্গলমহলের মা বলেছিলেন, সেই তাঁর দলের বিরুদ্ধেই ঘাটালে প্রার্থী হয়েছেন ভারতী ঘোষ। ইভিএমের লড়াইটা যতই দেবের সঙ্গে হোক না কেন, ভারতীর আসল লড়াইটা তো একসময়ে মায়ের সম্মান দেওয়া মমতার সঙ্গেই। মমতাকে অনেক কিছুর জবাব দেওয়ার লড়াই তাঁর।
এবারের নির্বাচনে বার বার মমতার মুখেও মায়ের কথা শোনা গিয়েছে। না তাঁর দলীয় স্লোগান মা-মাটি-মানুষ তো আছেই, একইসঙ্গে নির্বাচনী সভাগুলিতে বারংবার নিজের স্বর্গীয় মা গায়ত্রীদেবীর কথা উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে দেখতে ভিড় করা মহিলাদের উদ্দেশে বলেছেন, "জানেন তো, আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে, আপনাদের মধ্যেই নিজের মাকে খুঁজে পাই আমি।" বিরোধীরা স্বভাবতই এর মধ্যে রাজনীতি খুঁজবেন। সে বিতর্ক চলতেই পারে। ভোট চাইতে এমন কত আবেগই জনতার মন ভেজাতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন নেতারা। কিন্তু ভোটের ফল নির্ণয় মায়েদের ভূমিকা যে গুরুত্বপূর্ণ, তা প্রমাণ করার জন্য এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে।
এই যেমন ধরুন একশো ছুঁই ছুঁই হীরাবেন মোদী. রাজনীতি থেকে দূরে থেকেও দূরে থাকার উপায় নেই তাঁর। প্রধানমন্ত্রীর মা যে. তাই ভোটের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বৃদ্ধা মায়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রী ছেলের দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, "যিনি নিজের মা, স্ত্রীকে সম্মান দেন না, তিনি কীভাবে দেশের দায়িত্ব নেবেন।" আবার ভোটের মধ্যেই বহু চর্চিত সাক্ষাতকারে নরেন্দ্র মোদী অক্ষয় কুমারকে শুনিয়েছেন, আজও দেখা হলে কীভাবে প্রধানমন্ত্রী ছেলেকে হাতখরচার টাকা তুলে দেন তাঁর মা। এবারের ভোটে তাই ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন মায়েরা। রাজনীতির কচকচানির মাঝে মা এবং সন্তানের এই নিখাদ ভালবাসার গল্প শুনতে অন্যরকমই লাগে। কিন্তু ঘুরেফিরে সেই প্রশ্ন ওঠে, ভোটের বাজারে কি সচেতনভাবেই মাকে নিয়ে এই আবেগ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
গতবার সম্মুখসমরে থাকলেও এবারের নির্বাচনে যেন অনেকটাই আড়াল থেকে লড়াই করছেন আরও এক মা। তিনি কংগ্রেসের প্রাক্তন সভানেত্রী সোনিয়া গাঁধী। দলের ব্যাটন অনেক দিনই ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন. দাদার হাত শক্ত করতে ময়দানে নেমে পড়েছেন মেয়ে প্রিয়ঙ্কাও। সোনিয়া নিজে এবারেও রায়বরেলি থেকে লড়ছেন। জয়ও একরকম নিশ্চিত। কিন্তু সোনিয়ার আসল জয় তো হবে রাহুল-প্রিয়ঙ্কা জিতলে, ছেলে-মেয়ের হাত ধরে পাঁচ বছর আগে লজ্জার হারের উপযুক্ত জবাব দিতে পারলে, আসলে জিতে যাবেন সোনিয়াই। পাঁচ বছর আগে ইউপিএ দুই সরকারের চেয়ারপার্সন ছিলেন সোনিয়া। বকলমে তিনিই সরকার চালাতেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের। এমন কী, কংগ্রেসের ভারও ছিল তাঁর হাতে। গত লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের একপেশে হারের যন্ত্রণা কি এবার রাহুল-প্রিয়ঙ্কার হাত ধরে কাটিয়ে উঠতে পারবেন তিনি? দিন গুনছেন সোনিয়াও। দুঁদে রাজনীতিবিদ হলেও তিনি মা, সন্তানের জয়ের থেকে আর বড় আনন্দ কীসে!
আরও এক মাকে এবারের নির্বাচনে দেখেছে বাংলা। যিনি প্রার্থী হিসেবেও হেভিওয়েট নন, মা হিসেবেও নন। সবকিছু ঠিকঠাক চললে হয়তো এই সময়টা নিজের সন্তানের জন্যই নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিতেন। কিন্তু রাজনীতির অঙ্ক তাঁকে সেই সুযোগ দিল না। নদিয়ার রানাঘাটের প্রার্থী সদ্য পঁচিশে পা দেওয়া রূপালি বিশ্বাস নিজের বছর দেড়েকের একরত্তি ছেলেকেও এর পর কতটা সময় দিতে পারবেন, তা ঠিক হয়ে যাবে তেইশে মে। সাংসদ হলে আজ দিল্লি, কাল কলকাতা করতে হবে। ছেলের সঙ্গে সামলাতে হবে সাংসদের দায়িত্ব, শিখতে হবে রাজনীতির মারপ্যাঁচ। বিধায়ক স্বামী খুন হওয়ায় অঙ্ক কষেই তাঁকে প্রার্থী করেছে দল। স্বামী হারিয়ে একমাত্র সন্তানকে অবলম্বন করে বাঁচতে চাওয়া এক মায়ের ভবিষ্যতও ঠিক করে দেবে এবারের ভোট।