বর্ধমানের সিরিয়াল কিলার গ্রেফতার কাণ্ডে চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি অভিযুক্ত কামরুজ্জামানের। পুলিশের দাবি, ধৃত সিরিয়াল কিলার কামরুজ্জামান জেরায় জানিয়েছে, খুন করার পরে মৃত মহিলাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা করত সে। তারপরে মৃত মহিলাদের যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে দিত অভিযুক্ত কামরুজ্জামান।
২০১৩ সাল থেকে অন্তত সাতজন মহিলাকে খুন করার অভিযোগে রবিবার বর্ধমানের কালনা থেকে কামরুজ্জামান সরকার নামে ওই যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। বিভিন্ন বয়সের এগারো থেকে বারোজন মহিলার উপরে বার বার হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে চারজন প্রাণে বাঁচলেও সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় চেন গলায় জড়িয়ে শ্বাসরোধ করে নয়তো মাথায় ভারী বস্তু দিয়ে আঘাত করে হত্যা করত কামরুজ্জামান। কিন্তু কোন আক্রোশ থেকে সে এরকম ঘটনা ঘটাতো তা নিয়ে ধন্দে ছিল পুলিশ। কামরুজ্জামানের স্বীকারোক্তির পরে তদন্তকারীরা অনেকটাই নিশ্চিত, মানসিক বিকৃতি থেকেই মহিলাদের খুন করে যৌন লালসা তৃপ্ত করার চেষ্টা করত অভিযুক্ত।
পূর্ব বর্ধমান জেলার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, মূলত জেলার কালনা, মন্তেশ্বর এবং মেমারি থানা এলাকায় একই কায়দায় মহিলাদের উপরে হামলা চলছিল। এছাড়াও হুগলির পাণ্ডুয়া এবং বলাগড়ে একই কায়দায় কয়েকজন মহিলার উপরে আক্রমণ চালানো হয়। এর থেকেই পুলিশের অনুমান হয়, সম্ভবত একই ব্যক্তি এই কাণ্ড ঘটাচ্ছেন। শেষ কয়েকটি খুনের ঘটনায় খুনের পরে মৃতদেহের উপরে যৌন অত্যাচার চালানো হয় বলে জানান ভাস্করবাবু। আক্রান্ত যে মহিলারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন, তাঁদের বর্ণনা শুনে আততায়ীর ছবি আঁকানো হয়। শেষ কয়েক মাসে মহিলাদের উপরে হামলার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পরে আরও তৎপর হয় পুলিশ। সূত্র মারফত পুলিশ জানতে পারে, আততায়ী একটি লাল-কালো মোটরসাইকেলে চড়ে আসছে এবং তার সঙ্গে একটি লাল রংয়ের বাজারের ব্যাগ ব্যবহার করছে। সেই সূত্র ধরে এবং সিসিটিভি ফুটেজের সাহায্যে আততায়ীর বর্ণনা দিয়ে নাকা চেকিং শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত কালনার একটি গ্রামের রাস্তায় নাকা চেকিং চালানোর সময়ে অভিযুক্তকে ধরে ফেলেন কয়েকজন সিভিক ভলান্টিয়ার। কামরুজ্জামানের সঙ্গে থাকা লাল ব্যাগ উদ্ধার হয় সাইকেলের চেন এবং একটি শাবল।
ভাস্করবাবু স্বীকার করে নিয়েছেন, কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়াই একা কোনও ব্যক্তি এভাবে পরের পর খুন করতে থাকলে তার নাগাল পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রেও সেই সুযোগটাই নিয়েছে অভিযুক্ত কামরুজ্জামান। কিন্তু কোন মানসিক বিকার থেকে এভাবে মহিলাদের উপরে সে হামলা চালাতো, তা নিয়ে এখনও বিভ্রান্ত পুলিশ।
মনোবিদ লোপমুদ্রা গোস্বামী জানিয়েছেন, সাধারণত এই ধরনের মানসিক বিকারকে নেকরোফিলিয়া বলা হয়। এই মানসিক রোগে যাঁরা ভোগেন, তাঁদের মধ্যে মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বাসনা তৈরি হয়। সেই তাগিদ থেকেই এমন অপরাধ করতে পারেন তাঁরা। এর পিছনে সম্ভাব্য অনেকগুলি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন লোপামুদ্রাদেবী। তাঁর ব্যাখ্যা, "নেকরোফিলিয়াতে যাঁরা ভোগেন, তাঁরা প্রত্যাখ্যাত হতে চান না। ফলে কাউকে মেরে ফেললে আর যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাছাড়া এই ধরনের রোগীরা অন্যের তৃপ্তি-অতৃপ্তির বিষয় নিয়েও মাথা ঘামাতে চান না। এক্ষেত্রেও মৃত কোনও মানুষের তৃপ্তি-অতৃপ্তির প্রশ্ন থাকে না।"
আরও কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন লোপামুদ্রাদেবী। তিনি জানিয়েছেন, সাধারণত যাঁরা এমন মানসিক বিকারে আক্রান্ত হন, তাঁদের সামাজিক বা পারিবারিক কারণেই আত্মসম্মান বোধ খুব কম হয়। ফলে জোর করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা অন্য কোনওভাবে কারও উপরে নিজের জোর খাটানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। কোনও মানুষকে মেরে ফেলতে পারলে তার উপরে যে কোনও জোর খাটাতেও কোনও সমস্যা হয় না। তবে এক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কোনও খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে এমন মানসিক বিকার জন্মানোর সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না লোপামুদ্রাদেবী।
পুলিশি জেরায় অভিযুক্ত কামরুজ্জামান স্বীকার করেছে, মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টাই শুধু নয়, মৃতদের যৌনাঙ্গে রড দিয়ে আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করে দিতে সে। লোপামুদ্রাদেবী ধারণা, এ ক্ষেত্রে যাঁর উপর যৌন অত্যাচার চালানো হচ্ছে, তিনি জীবিত না মৃত, সেই বোধ কাজ করে না বিকারগ্রস্ত ব্যক্তির। উল্টে তার পরে অন্য কেউ যাতে ওই মহিলার সঙ্গে আর যৌন সম্পর্ক স্থাপন করতে না পারে, সেই ভাবনা থেকেই যৌনাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করার প্রবণতা আসতে পারে। ওই মনোবিদের দাবি, এই ভাবনা থেকেই অনেক সময় ধর্ষণের পরে নির্যাতিতাকে প্রাণে মেরে ফেলা হয়।
এই ধরনের মানসিক বিকারে যাঁরা আক্রান্ত হন, তাঁদের বাইরে থেকে দেখে কোনও উপসর্গও সহজে বোঝা যায় না বলে দাবি তাঁর। প্রতিটি ক্ষেত্রে মানসিক বিকারের নেপথ্যে থাকা কারণও আলাদা হতে পারে। তবে মূল সমস্যার জড়ে পৌঁছতে পারলে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় এই ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্তদের সুস্থ করা সম্ভব বলেই জানিয়েছেন ওই মনোবিদ।
পূর্ব বর্ধমানের পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, কয়েকটি ক্ষেত্রে খুন করার পরে সেই মহিলার বাড়ি থেকে কিছু জিনিস চুরি করেছে কামরুজ্জামান। কিন্তু শুধু চুরি করার উদ্দেশ্যেই সে এরকম নৃশংস হত্যালীলা চালাত কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে পুলিশের। আপাতত ধৃতকে চোদ্দ দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়ে আরও জেরা করতে চাইছে পুলিশ। প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পুনর্নির্মাণও কামরুজ্জামানকে দিয়ে করানো হবে। কোনও ফাঁক না রেখেই প্রতিটি খুনের ঘটনায় তার নাম যুক্ত করে চার্জশিট তৈরি করতে চায় পুলিশ। ইতিমধ্যে কামরুজ্জামানের গ্রামের বাড়িতেও হানা দিয়েছে পুলিশ। পেশায় পুরনো জিনিস কেনাবেচার কারবারি কামরুজ্জামানের বাড়ি থেকে রুপোর গয়নার পাশাপাশি বেশ কিছু চুরি করা সোনার গয়নাও উদ্ধার করেছে পুলিশ।
শান্ত স্বভাবের কামরুজ্জামান যে এভাবে পরের পর খুন করতে পারে, তা বিশ্বাস করতে পারছেন না কালনার সুজনপুর গ্রামের বাসিন্দারা। বছর দেড়েক আগে এই গ্রামেই বাড়ি করে কামরুজ্জামান। স্ত্রী, দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে নিয়ে এখানে থাকত সে। গ্রামের কারো সঙ্গেই খুব বেশি কথাও বলত না সে।