রাজ্য রাজনীতিতে যেকয়েকটি উত্তপ্ত এলাকার নাম রয়েছে তারমধ্যে বর্তমানে ভাঙড় সবথেকে বেশি উত্তেজনা প্রবণ। বাম জমানার শেষ পর্ব থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে ভাঙড়ের নাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
পঞ্চায়েত ভোটে সবথেকে বেশি হিংসার ঘটনা ঘটেছে ভাঙড়ে। দিন ঘোষণার পর থেকেই অশান্তি শুরু। মনোনয়নপর্বে তা মাত্রা ছাড়িয়েছিল। মনোনয়ন পর্বেই তৃণমূল কংগ্রেস ও ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের দুই সদস্যের মৃত্যু হয়। ভোটের দিনও বিক্ষিপ্ত অশান্তির ঘটনা ঘটেছে ভাঙড়ে। এলাকার বিধায়ক আইএসএফএর নৌসাদ সিদ্দিকী একাধিকবার নিজের জীবন বিপন্ন বলেও দাবি করেছিলেন। আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন নিরাপত্তার জন্য অবশেষে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাও পেয়েছিলেন। যাইহোক কিন্তু ভোট পর্বে কেন ভাঙড় জুড়ে এই আশান্তির ছবি ধরা পড়েছে- তাই নিয়েই শুরু হয়েছে কাঁটাছেঁড়া।
রাজ্য রাজনীতিতে যেকয়েকটি উত্তপ্ত এলাকার নাম রয়েছে তারমধ্যে বর্তমানে ভাঙড় সবথেকে বেশি উত্তেজনা প্রবণ। বাম জমানার শেষ পর্ব থেকেই রাজ্য রাজনীতিতে ভাঙড়ের নাম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই এলাকায় একটা সময় বামেদের সঙ্গে মূল লড়াই ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের। নেতা হিসেবে একটা সময় দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন আরাবুল , কাইজাররা। সেই সময় বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক সওকত মো্লা সিপিএমএর পক্ষে ছিলেন। রাজ্যে পালা বদলের পর তিনি দল পরিবর্তন করেন। তারপরই ঘাসফুল পাতাকা হাতে তুলে নিয়ে ভাঙ়ড়ের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। তৃণমূল কংগ্রেস জমানার শুরু থেকেই এই এলাকায় ঘাসফুল শিবিরের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু ২০২১ সাল থেকেই পট পরিবর্তন হতে শুরু করে। যদিও তার আগে থেকেই ভাঙড়ে তৃণমূলের শক্ত ভিত একটু একটু করে আলগা হচ্ছিল।
ভাঙড়ে একাধিক আন্দোলন হয়েছে। কৃষি জমি রক্ষা আন্দোলন তার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই কারণেই বারবার বাধা পেয়েছে বিদ্যুৎ প্রকল্প। আন্দোলন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে স্থানীয়রা বিদ্যুৎ প্রকল্পের গেটে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে জোর করে জমি দখলেরও অভিযোগ উঠেছিল। যার মধ্যে প্রথমেই নাম ছিল আরাবুলের। যাইহোক সেসব এখন অতীত। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগেই তৈরি হওয়া রাজনৈতিক দল আইএসএফকেই বেছে নেন ভাঙড়ের বাসিন্দারা। রাজ্যের একমাত্র আইএসএফ বিধায়ক নৌসাদ সিদ্দিকী ভাঙড় থেকেই জয়ী হয়েছেন। তারপর অবশ্য অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের মত দল বদল করেননি। তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন করেছেন। মাত্র ৩০ বছরের নৌসাদের উত্থানে কিছুটা হলেও অস্বস্তি বাড়ছে তৃণমূল শিবিরে।
অন্যদিকে ভাঙড়ে প্রথম থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের হটস্পট। একটা সময় আরাবুল আর কাইজারের লড়াই দেখেছে বাংলা। যদিও রাজনীতিতে বর্তমানে তিনি কিছুটা হলেও কোনঠাসা। অন্যদিকে ভাঙড়ে এলাকা দখলের সবথেকে বড় লড়াই আরাবুল আর সওকত মোল্লার মধ্যে। যদিও সওকত ক্যানিং পূর্বের বিধায়াক। কিন্তু তাঁর রাজপাট ভাঙড়েই। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এলাকায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব মেটাতে তৃণমূল কংগ্রেস ভাঙড়ের মাটিতে নামিয়েছিল সব্যসাচীকে।
যাইহোক ক্ষমতায় আসার পরথেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে ক্ষমতা দখলের প্রতীক হল পঞ্চায়েত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়ী হওয়া। সেক্ষেত্রেও ভাঙড়ে এগিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস। এবারও সেই একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে। ভাঙড় এক নম্বর পঞ্চায়েতে প্রায় কোনও আসনেই বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। আর সেই জন্য ব্লক আর পঞ্চায়েত আর জেলা পরিষদের সবকটি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় লাভ করেছে তৃণমূল প্রার্থীরা। ভাঙড়-১ এর ২২৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের মধ্যে মাত্র দুটিতে ভোট হয়েছে। একই ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস ২৭টি ব্লক আর দুটি জেলা পরিষদের আসন জয় করেছে। অন্যদিকে ভাঙড় ২ নম্বরে ২১৮ পঞ্চায়েত, ৩০টি ব্লক আর তিনটি জেলা পরিষদের আসন রয়েছে। তারমধ্যে ১৪টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় জয়ী তৃণমূল। ভোট হয়েছে ১৩০টি আসনে। অন্যদিকে একটি ব্লকে ৮২জন আইএসএফ প্রার্থী ও ১৯ সিপিআইএম প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে তাদের ভোটপত্রের ত্রুটির কারণে। আর এই কারণে ভাঙড়ে যে কটি আসনে নির্বাচন হয়েছিল তাতে অশান্তি না হওয়াই ঠিক ছিল। কারণ বিরোধীদের থেকে অনেক অনেক এগিয়ে ছিল তৃণমূল।
তবে স্থানীয় রাজনীতিবিদরা বলছেন অন্যকথায ভাঙড়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় তৃণমূল কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। আর সেই কারণে যেসব আসনে ভোট হয়েছে সেখানেও জয়ের প্রয়োজন রয়েছে ঘাসফুল শিবিরের। তবেই নেতারা তাদের গ্রহণযোগ্যতা যে সর্বস্তরের মানুষের কাছে রয়েছে তা দাবি করতে পারবেন। আগামী বছর লোকসভা নির্বাচন। আর সেই কারণে যেকটি আসনে ভোট হয়েছে সেই আসনে জেতা অত্যান্ত জরুরি। তাতেই তৃণমূলের নেতারা যে গণতন্ত্রের ওপর আস্থাশীল সেই দাবি করতে পারবেন। নাহলে রাজ্যে গণতন্ত্র বিপন্ন বলে যে দাবি বিরোধীরা করছে তাতেই সিলমহর পড়বে।