আভিধানিক ভাবে দেবী পার্বতীর দুর্গার রূপের নয়টি রূপকে বোঝানো হয় ৷ হিন্দু পুরাণ অনুসারে এগুলো দেবী পার্বতীর নয়টি ভিন্ন রূপ ৷ এই নয় রূপ হল যথাক্রমে - শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুষ্মাণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী এবং সিদ্ধিদাত্রী ৷ প্রতি শরৎকালে নবরাত্রির নয় দিনে প্রতিদিন দেবী পার্বতীর দুর্গা রূপের এই নয় রূপের এক একজনকে পুজো করা হয় ৷ আসলে এই নয়টি রূপের সগুন বর্তমান দেবী পার্বতীর দুর্গা রূপ। যেই রূপে দেবী পার্বতী বধ করেন দুর্গম অসুরকে।
১) শৈলপুত্রী- মা শৈলপুত্রীর বাহন বৃষ । এঁনার দক্ষিণ হস্তে ত্রিশূল আর বাম হস্তে কমল আছে তাই দেবীর অপর নাম শুল ধরিনি। ইনি পূর্ব জন্মে দক্ষ নন্দিনী সতী দেবী ছিলেন । দক্ষের অমতে তিনি শিব কেই বিবাহ করেন । প্রতিশোধে দক্ষ এক শিব হীন যজ্ঞের আয়োজন করেন । বিনা নিমন্ত্রণে সতী দেবী পিত্রালয়ে গিয়ে অনেক অপমানিত হলেন ও সতী রূপে আবির্ভূত মহামায়া দেহত্যাগ করলেন । এরপর ভগবান শিব দক্ষ যজ্ঞ ধ্বংস করেন । এই দেবী মহামায়া পর জন্মে হিমালয় কন্যা পার্বতী রূপে জন্ম নেন । শৈলরাজ হিমালয়ের কন্যা হবার জন্য দেবীর এক নাম শৈলপুত্রী । এবং পরজন্মে তিনি দেবাদিদেব শিবকেই পতি রূপে বরন করলেন । নবরাত্রির প্রথম দিনে মা শৈলপুত্রীর আরাধনা করা হয় ।
আরও পড়ুন- শারদীয়ার আগেই কাটিয়ে ফেলুন বাস্তুদোষ, ব্যবহার করুন এই ৩ উপাদান
২) ব্রহ্মচারিণী- মা পার্বতীর নবশক্তির দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণী। এখানে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ হল তপস্যা। ব্রহ্মচারিণী অর্থাৎ তপশ্চারিণী বা তপ আচরণকারী। কথিত আছে যে,‘বেদস্তত্ত্বং তপো ব্রহ্ম’বেদ, তত্ত্ব এবং তপ হল ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ। দেবী ব্রহ্মচারিণীর রূপ- জ্যোতিতে পূর্ণ, অতি মহিমামণ্ডিত। তিনি ডান হাতে জপের মালা এবং বাঁ হাতে কমণ্ডলু ধারণ করে আছেন।
৩) চন্দ্রঘণ্টা- এঁনার মস্তকে অর্ধচন্দ্র থাকে , তাই দেবীকে চন্দ্রঘণ্টা নামে ডাকা হয় । দেবীর এই স্বরূপ পরম কল্যাণকারী। এঁনার শরীরের রং স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল। এই দেবী দশভুজা । এঁনার হাতে কমণ্ডলু , তরোয়াল , গদা , ত্রিশূল , ধনুর্বাণ , পদ্ম , জপ মালা থাকে । দেবী তার ঘণ্টার ন্যায় প্রচন্ড চন্ড ধবনিতে দুরাচারী রাক্ষস , দানব , দৈত্য দের প্রকম্পিত করেন ।
আরও পড়ুন- দেবীপক্ষে এই কাজ করলে সোনা দানের থেকেও বেশি পুণ্যলাভ হয়, জেনে নিন সেই টোটকা
৪) কুষ্মাণ্ডা- দেবী পার্বতী তার চতুর্থ স্বরূপে "কুষ্মাণ্ডা" নামে পরিচিতা। নবরাত্রের চতুর্থদিনে, অর্থাৎ চতুর্থী তিথিতে মাতৃপ্রাণ ভক্তগণ এই কুষ্মাণ্ডারূপেই আদ্যাশক্তিকে আহ্বান করে থাকেন। দেবী সিংহবাহিনী, ত্রিনয়নী ও অষ্টভুজা। আটটি হাতে সুদর্শনচক্র, ধনুর্বাণ, রক্তপদ্ম, কমণ্ডলু, ইত্যাদি দৃষ্টিগোচর হয়। মায়ের বামহস্তে একটি অমৃতপূর্ণ কলসও রয়েছে। এখানে অমৃত ব্রহ্মের রূপক, দেবী ভগবতী পার্বতী অমৃতপূর্ণ কলস অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের আধার হাতে নিয়ে বসে রয়েছেন।
৫) স্কন্দমাতা- মা দুর্গার পঞ্চম শক্তি হল স্কন্দমাতা। স্কন্দের জননী হওয়ায় তাঁকে স্কন্দমাতা বলা হয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে সূর্যমণ্ডলের প্রধান দেবতা হওয়ার কারণে, তাঁর সুন্দর চিত্রটি বিশ্বজুড়ে আলোকিত হয়েছে।
৬) কাত্যায়নী- এই নাম এবং রূপের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক পৌরাণিক কাহিনি | বৈদিক যুগে কাত্যায়ন নামে এক ঋষি ছিলেন | এক পুত্রের পিতা কাত্যায়নের ইচ্ছে হয় একটি কন্যসন্তান লাভের | দেবী পার্বতী র তপস্যা করে তিনি অভীষ্ট পূর্ণ করেন | তার স্তবে তুষ্ট হয়ে স্বয়ং দেবী পার্বতী জন্ম নেন মহারিশি কাত্যায়নের কন্য রূপে | তখন তার নাম হয় কাত্যায়নী | নবরাত্রির ষষ্ঠ দিনে আরাধিতা হন ভক্তদের কাছে |দেবী পার্বতী এই রূপ নিয়ে মহিষাসুর কে বধ করেন
৭) কালরাত্রি- এখানে দেবী কৃষ্ণবর্ণা | আলুলায়িত কেশে তিনি ধাবিত শত্রুর দিকে | তার কণ্ঠে বিদ্যুতের মালিকা | ত্রিনয়নী দেবীর শ্বাস প্রশ্বাসে বেরিয়ে আসে আগুনের হলকা | ভীষণদর্শনা দেবীর তিন হাতে অস্ত্র | এক হাতে ভক্তদের প্রতি বরাভয় | এই রূপই উপাসিত হয় কালিকা রূপে | তবে এই রূপেও দেবী ভক্তের শুভ করেন | তাই অন্যদিকে তিনি শুভঙ্করী | দেবীর বাহন গর্দভ | ভক্তরা তার পুজো করেন নবরাত্রির সপ্তম রাতে |
৮) মহা গৌরী- হিমায়লকন্যা ছিলেন গৌর বর্ণা। শিবের তপস্যা করে রৌদ্রে তিনি কৃষ্ণা হন | মহাদেব যখন গঙ্গাজল দিয়ে তাকে স্নান করান, তখন তিনি হয়ে ওঠেন ফর্সা | তার এই রূপের নাম হয় মহাগৌরী | প্রচলিত বিশ্বাস, নবরাত্রির অষ্টম রাতে তার পুজো করলে সব পাপ ধুয়ে যায় | সাদা পোশাক পরিহিতা, চার হাত বিশিষ্টা দেবীর বাহন ষাঁড় | দেবীর এক হাত শোভিত বরাভয় মুদ্রায় | বাকি তিন হাতে থাকে পদ্ম, ত্রিশূল এবং ডমরু |
৯) সিদ্ধিদাত্রী- নবদুর্গার নবম তথা শেষ রূপ হল সিদ্ধিদাত্রী | সিংহবাহিনী দেবীর চার হাতে আশীর্বাদী মুদ্রা | তিনি সিদ্ধি দান করেন | অর্থাত্ তার উপাসনায় সংসারে আসে সুখ এবং সমৃদ্ধি | সবাইকে বরাভয় দেন এই মাতৃকামূর্তি | দেবী ভগবত্ পুরাণে আছে, স্বয়ং মহাদেব দেবী পার্বতী কে সিদ্ধিদাত্রী রূপে পুজো করেছিলেন | এবং তার ফলে মহাদেব সকল সিদ্ধি লাভ করেন | সিদ্ধিদাত্রীর আশীর্বাদেই সর্ব সিদ্ধি লাভ করেন মহাদেব | নবদুর্গার শেষ রূপটি হল ‘সিদ্ধিদাত্রী’। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণে’-এ ‘সিদ্ধিদাত্রী’ অষ্টভুজা, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের শ্রীকৃষ্ণজন্ম খণ্ডে ‘সিদ্ধিদাত্রী’ অষ্টাদশভুজা। ‘সিদ্ধিদাত্রী’ চতুর্ভুজা রূপেও দেখা যায়। সেখানে তিনি শিবের আরাধ্য। এই হল নবদুর্গার চর্চিত কাহিনি।