জানেন কি, উত্তমকুমারের ইচ্ছে পূর্ণ করতে পারেন নি ঋত্বিক ঘটক

  • প্যারাডাইস ক্যাফের তর্ক আর আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন ঋত্বিক ঘটক
  • সিনেমা ঋত্বিকের সাধনা হলেও তাঁর স্বপ্ন জুড়ে ছিল নাটক
  • উত্তমকুমারের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের দেখা হয়েছে এনটি-ওয়ান স্টুডিওর ক‍্যান্টিনের সামনে
  • উত্তমকুমারকে নিয়ে ঋত্বিক কোনও ছবির কথা ভেবেছিলেন এমন গল্প এখনও পাওয়া যায় নি

Tapan Malik | Published : Nov 4, 2020 10:08 AM IST

দেশ তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে। দেশ ভাগ হওয়ার আগে থেকেই ওপার বাংলার বাঙালিরা কলকাতায় আসতে শুরু করেছিলেন। সেই সময় কলকাতার হাজরা রোডের ওপর একটা চায়ের দোকানে নিয়মিত আড্ডা দিতেন একদল যুবক। কাঠের চেয়ার-টেবিল আর চায়ের ধোয়ায় দেশ-দেশের স্বাধীনতা-দেশভাগ-রাজনীতি- সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে তুফান তুলত সেই যুবকেরা। আড্ডা আর তর্কে জমে ওঠা গেল শতকের প্যারাডাইস ক্যাফে কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও সেদিনের তর্কের সেই যুবকরা ইতিহাস গড়লেন। তাদের মধ্যে বিমল রায়, সলিল চৌধুরী, হ্রিষিকেশ মুখোপাধ্যায় চলে যান মুম্বাই। রয়ে যান মৃণাল সেন, বিজন ভট্টাচার্য-সহ আরও অনেকে। তবে হাজরা রোডের প্যারাডাইস ক্যাফের প্রতিদিনকার তর্ক আর আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। বলা যায় তাঁর রাজনীতি আর সিনেমার সূতিকাগার ছিল ওই চা দোকানের তেলচিটে চেয়ার-টেবিল। সেদিনিকার তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়াও ছিলেন তিনি।

সিনেমা ঋত্বিকের সাধনা হলেও তাঁর স্বপ্ন জুড়ে ছিল নাটক। একসঙ্গে অনেক মানুষকে নিজের কথা বলার একমাত্র ও সর্বাধুনিক মাধ্যম বলেই ঋত্বিকের সিনেমাতে আসা। তাছাড়া সিনেমার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে যায় মেজদা সুধীশ ঘটক মারফত। তিনি ব্রিটেনে ডকুমেন্টারি ফিল্মের ক্যামেরাম্যান হিসেবে বহু বছর কাজ করার পর নিউ থিয়েটার্সে যুক্ত হন এবং বহু ছবিতে ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করেন। যেমন কাননবালা-সায়গলের ‘স্ট্রিট সিঙ্গার’। বাড়িতে আসতেন প্রমথেশ বড়ুয়া, বিমল রায় প্রমুখ। সিনেমা আন্দোলনে একজন ‘কর্মী’ হিসেবে ঋত্বিক জড়িয়ে পড়েছিলেন। এরপরেই মনোজ ভট্টাচার্যের ‘তথাপি’ নামক ছবিতে তিনি সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। তার পরের বছরই নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’-এ ঋত্বিক সহকারী পরিচালক এবং  অভিনেতা।‘ছিন্নমূল’ছবিতে কাজ করার সময় তাঁর সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের পরিচয় হয়েছিল।

ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে গল্পের শেষ নেই। যারা এক সময় তাঁকে দেখে রাস্তার উলটো পাড় দিয়ে জোড় পায়ে হাঁটা লাগাতেন তাঁরাও নিজের সঙ্গে ঋত্বিককে জড়িয়ে গল্প ফাঁদতে ছাড়েন নি। তাই তাঁকে ঘিরে অনেক গল্পের সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে যায়। ঋত্বিক ঘটকের বহু ছবির কাজ মাঝপথে থেমে গিয়েছিল। বহু ছবির চিত্রনাট্য লেখা শেষ হলেও কাজ শুরু হয় নি। পাশাপাশি এমন বিষয় নিয়ে তিনি ছবির পরিকল্পনা করেছিলেন যা ভাবাই কঠিন। ঋত্বিক ঘটক লিও টলস্টয়ের ‘রেজারেকশন’ নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা ভেবেছিলেন। কেবল ভাবনা নয় ঋত্বিকের রেজারেকশন পরিকল্পনায় সুচিত্রা সেনকে দিয়ে অভিনয় করানোর কথা ভেবেছিলেন তিনি। সে কথা তিনি শ্রীমতি সেনকে জানিয়েওছিলেন। শোনা যায় সুচিত্রা সম্মতি দিয়েছিলেন। তবে ছবিটা শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনাতেই থেমে থাকে। এমনও শোনা যায় যে, ঋত্বিক ঘটকের ‘রঙের গোলাম’ ছবিতে সুচিত্রা সেনের অভিনয় করার কথা ছিল। কিন্তু রেজারেকশন ছবিতে কাজ করতে সম্মত হলেও ‘রঙের গোলাম’-এ কাজ করতে সুচিত্রা সেন নাকি আপত্তি করেছিলেন। 

উত্তমকুমারকে নিয়ে ঋত্বিক কোনও ছবির কথা ভেবেছিলেন এমন গল্প এখন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। তবে তাঁদের দুজনের মধ্যে যে সখ্যতা ছিল তা বোঝা যায় একটি ঘটনায়। টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে শুটিংয়ের মধ্যেই মহানায়ক হঠাৎ শুনলেন যে,  ঋত্বিক ঘটক অসুস্থ অবস্থায় নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছেন।এর কিছুদিন পর ঋত্বিক শুরু করবেন ‘তিতাস’-এর শুটিং। মহানায়ক স্যুটিং থামিয়েই ছুটলেন ঋত্বিক ঘটককে দেখতে। তখন দিনের বেলায় কলকাতার নার্সিংহোমে যাওয়াটা মহানায়কের পক্ষে ঝুঁকির, তা স্বত্বেও তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। এর আগে বেশ কয়েকবার উত্তমকুমারের সঙ্গে ঋত্বিক ঘটকের দেখা হয়েছে এনটি-ওয়ান স্টুডিওর ক‍্যান্টিনের সামনে। ঋত্বিক ঘটকের সেই এক কথা, "উত্তম আমি একটা ছবি করছি, তুমি হবে তাঁর হিরো, করবে তো?  অত‍্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে উত্তমকুমারের একটাই জবাব দিতেন, ‘এ কথা তো রোজই বলেন আপনি, যেদিন খুশি শুরু করুন, আপনার জন্য আমার সময়ের অভাব হবে না’। নার্সিঙ্ঘোমে শুয়েও উত্তমকে দেখে ঋত্বিকের সেই একই কথা।সেরে উঠেই তোমাকে নিয়ে সেই ছবি বানাবো। উত্তমকুমার সেকথা শুনে সেদিনও হেসে বলেছিলেন, ‘সে দেখা যাবে, আগে আপনি সেরে উঠুন’। তবে উত্তমকুমার মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলেন যে ‘বনপলাশীর পদাবলী’ ছবিটি তিনি ঋত্বিক ঘটককে দিয়েই করাবেন। উত্তমকুমার সে প্রস্তাব ঋত্বিক ঘটকের কাছে রাখলে নারাজ হন নি। আসলে সে সময় টাকার খুব দরকার ছিল। শোনা যায় উত্তমকুমার এর জন্য তাকে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। ঋত্বিক খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন, উত্তমকুমার বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেন কিন্তু ঋত্বিক আর সেরে উঠতে পারেন নি।
 

Share this article
click me!