কাঠগড়ায় 'রিয়া', বিচার নাকি একটি মেয়েকে পীড়ন করার দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ

 

  • তদন্তটা ছিল সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে
  •  তদন্তের মনোযোগ একশো শতাংশ ঘুরে গিয়ে আপাতত লক্ষ্য রিয়া চক্রবর্তী
  •   অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১০ বছরের জেল হতে পারে রিয়ার
  • দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও অপরাধীদের সঙ্গে এ ধরণের আচরণ কি করা যায়
     

Tapan Malik | Published : Sep 12, 2020 11:44 AM IST

তদন্তটা ছিল সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নিয়ে। কিন্তু সেই তদন্তের মনোযোগ একশো শতাংশ ঘুরে গিয়ে আপাতত লক্ষ্য রিয়া চক্রবর্তী। গ্রেপ্তারের পর রিয়াকে পাঠানো হয় ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতে। গ্রেপ্তারের পর রিয়ার ডাক্তারি পরীক্ষায় মাদকের নমুনা মেলে না, কভিড-১৯ পরীক্ষার ফলও নেগেটিভ। এরপর ভার্চুয়াল আদালতের বিচারে অভিনেত্রীর দু’সপ্তাহের বিচার বিভাগীয় হেফাজত মঞ্জুর হয়। নারকোটিকস কন্ট্রোল ব্যুরোর অশোক জৈন জানান, ‘রিয়ার বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে, তার ভিত্তিতেই ওকে গ্রেপ্তার করেছি’। নারকোটিকস সূত্র এও জানায়, অভিযোগ প্রমাণিত হলে ১০ বছরের জেল হতে পারে রিয়ার। 

এর আগে সংবাদমাধ্যম খবর করেছিল, অভিনেত্রী দাবি করেছেন, মাদকের সঙ্গে তাঁর যা সম্পর্ক সব সুশান্তের জন্যই। শেষমেষ মাদক কারবারের সঙ্গে যোগ থাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন রিয়া চক্রবর্তী। প্রসঙ্গত; মাদকের সঙ্গে বলিউডের সম্পর্ক আজকের নয়। প্রথমেই বলা যায় সঞ্জয় দত্তর কথা। ১৯৮২ সালে তিনি অবৈধ মাদক বহনের দায়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে তাঁকে আমেরিকার পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠানো হয়। রণবির কাপুর নেশা কাটানোর জন্য জর্মানিতে চিকিৎসা নেওয়ার কথা নিজেই জানিয়েছিলেন। মাদক কারবারের সঙ্গে মমতা কুলকার্নির যোগাযোগ ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ভারতে ও ভারতের বাইরে অন্তত পাঁচবার মাদক চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন তিনি। শাহরুখ খানের স্ত্রী গৌরি খানের কাছে গাজা থাকায় বার্লিন বিমানবন্দরে তাঁকে সাময়িকভাবে আটক করা হয়। জানা যায়, একই নেশা ছিল হৃতিক রোশানের স্ত্রী সুজানে খানেরও। 

গ্রেপ্তারের আগে রিয়া কালো টি-শার্ট পরে ছিলেন। সেখানে লেখা ছিল, ‘রোজ আর রেড, ভায়োলেটস আর ব্লু, লেটস স্ম্যাশ পেট্রিয়ার্কি’। পুরুষতন্ত্রকে গুঁড়িয়ে দিতে রিয়ার এই বার্তা ছুঁয়েছে বলিউডকে। এত দিন যাঁরা রিয়া বা সুশান্তকে নিয়ে মুখ খোলেননি, তাঁরাও রিয়ার সমর্থনে বলেছেন, মেয়ে বলেই বলির পাঁঠা বানানো হল তাঁকে।  অনেকে মনে করেন, বলিউডের বহু তারকার সঙ্গে মাদকযোগ থাকলেও মূল ঘটনা থেকে দৃষ্টি সরাতে রিয়ার ঘাড়ে দোষ চাপানো হল। 

অন্যদিকে সুশান্ত অনুরাগীদের কাছে রিয়া চক্রবর্তী এখন ‘মোস্ট ওয়ান্টেড লেডি’! যে অনুরাগীরা  অভিনেতা বেঁচে থাকতে তাঁর অভিনয় নিয়ে একটি কথাও বলেন নি, তাঁর মৃত্যুর পর তাঁরাই এখন ন্যায় বিচারের আশায় নেটদুনিয়ায় কেঁদে ভাসাচ্ছেন। মেয়ে বলেই কি বলির পাঁঠা হতে হল রিয়াকে? মাদকচক্র যোগে যদি রিয়াকে জেলে যেতে হয়, তাহলে তো সুশান্ত বেঁচে থাকলে তাঁকেও এই একই শাস্তি ভোগ করতে হত?প্রেমিকের মৃত্যুতে প্রামিকার শাস্তির জন্য যে নেটজনতা রে রে উল্লাসে মত্ত তাদের কাছে প্রশ্ন, রিয়াকে ধস্ত করেই কি সুশান্ত সিং-এর মৃত্যুর সুবিচার মিলল? তবে তার রেশ ধরেই রিয়া চক্রবর্তীর সমর্থনে সুর চড়িয়েছেন বলিউড তারকাদের একাংশ। 

যথেষ্ট পুলিশকর্মীদের পাহারাতে রিয়া চক্রবর্তী এনসিবি অফিসে ঢোকার সময় রিয়াকে তাড়া করেছিলেন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। তাদের এই আচরণকে বলিউডের সেলিব্রিটি মহল বর্বরোচিত বলে আখ্যা দিয়েছেন। কেউ সংবাদকর্মীদের মিডিয়ার শকুন তকমা দিয়েছেন। কেউ সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে, প্রশ্ন তুলেছেন যথেষ্ট নিরাপত্তা থাকা স্বত্বেও এমন কেন অমনটা হল।  

অনেকে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে টুইট করে জানিয়েছেন, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেও অপরাধীদের সঙ্গে এ ধরণের আচরণ কি করা যায়? যারা তা করল তাদের কি বিচার হতে পারে না? মিডিয়া রিয়ার সঙ্গে যে রকম আচরণ করছে তাতে রীতিমতো ধিক্কার জানিয়েছেন অনেকেই। করোনা ভাইরাস অতিমারির সময়ে শারীরিক দূরত্বের বিধি মানার কথা ঢালাও প্রচার হচ্ছে। কিন্তু সেদিন সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা রিয়ার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে সেই বিধি অবলীলায় ভেঙে ফেললেন। মিডিয়াকর্মীদের ওই ধরণের আচরণকে ভর্ৎসনা করেছেন মুম্বাই সিনেমা দুনিয়া। শারীরিক দূরত্বের প্রসঙ্গ টেনে অনেকেই ঠাট্টা করে সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, সামাজিক দূরত্বের চূড়ান্ত নজির স্থাপন করলেন সংবাদকর্মীরা। অনেকেই প্রশ্ন করেছেন সভ্য সমাজ কি এভাবে কাজ করে? ন্যায়বিচারের পথটা যে এ রকম সেটা যেন বিশ্বাস করতে না হয়। 


রিয়া চক্রবর্তীর গায়ে গণহারে অপরাধী তকমা দেগে দেওয়া দেখে রীতিমতো শঙ্কিত বুদ্ধিজীবী মহল। তাঁরা বলছেন, এটা বিচার বা জিঙ্গাসাবাদ নয়, বরং একটি মেয়েকে পীড়ন করার দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। সেটা করার জন্যেও অন্য এক ধরণের মানসিকার দরকার হয়। এর পিছনে সমাজের গভীরে প্রোথিত নারী-বিদ্বেষের শিকড় দেখছেন সমাজতত্ত্ববিদরা। তাঁরা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন, নারী নরকের দ্বার-মার্কা মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণা এখনও আমাদের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। আজকের মেয়েরা নানা দিকে এগিয়ে গেলেও সুযোগ পেয়ে তাঁদের ধস্ত করার মনটা কিন্তু পুরোদস্তুর রয়ে গিয়েছে। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর কারণ এখনও অমীমাংসিত। সেই ঘটনার নিষ্পত্তির জন্য তোড়জোর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার এটাও মনে হচ্ছে প্রেম ঘটিত কারণ সামনে আসায় প্রেমিকের মৃত্যুতে একটি খলনায়িকার যেন দরকার হয়ে পড়েছে। কে কী দোষ করেছে, সত্যি-মিথ্যে কোনটা, তা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু তর সইছে না। রিয়া চক্রবর্তীকে পাওয়া গিয়েছে। তাই যেন সমাজ রাগ ক্রোধ উগরে দিচ্ছে তার ওপর।


 

Share this article
click me!