বিশ্ব আর্থিক মন্দায় আলো দেখাবে ভারতের ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম, ব্যাখ্যায় অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ সুদীপ্ত গুহ

ভারতে মুদ্রাস্ফীতি ৭%-এর কিছু বেশি হলেও, তাঁর কারণ মূলতঃ বিদেশ থেকে আসা সামগ্রী। যেমন জ্বালানি, সোনা এবং খাবারের তেল। যার জন্য আমরা বহির্বিশ্বের উপর নির্ভরশীল। দেশীয় পণ্যের মুদ্রাস্ফীতি নাগালের মধ্যেই। গত আর্থিক বর্ষে প্রায় অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচক বা মানদন্ডে, ভারত নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল অর্থব্যাবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে। 

Web Desk - ANB | Published : Jul 31, 2022 7:20 AM IST / Updated: Jul 31 2022, 03:28 PM IST

অতিমারী থেকে উদ্ভুত আর্থিক সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির (Expansionary Monetary Policy) আশ্রয় নেয় l অর্থাৎ বাজারের আরও বেশি মুদ্রা ছেড়ে দেয়া হয়, যাতে মানুষের হতে আরও বেশি পয়সা আসে এবং মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে । ক্রয় ক্ষমতা বাড়লে বাড়বে চাহিদা, চাহিদা বাড়াবে উৎপাদন, এই ছিল চিন্তা। শুধু G7 গোষ্ঠীভুক্তদেশগুলি $8 ত্রিলিয়ন মুদ্রা বাজারের ছাড়ে । এর আগে যতবার মন্দা এসেছে এইভাবেই তাঁরা সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে । কিন্তু এবারের সমস্যা তো আলাদা? ভারত একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, সেটা হল মুদ্রার অভাব এক্ষেত্রে সমস্যা নয়। সমস্যা হল, মুদ্রা থাকলেও খরচ করার জায়গা নেই । অফিসের গাড়ী, গণপরিবহণ, স্কুলের গাড়ি, রেস্টুরেন্ট, হোটেল থেকে হাসপাতাল সবার পরিষেবা বন্ধ। বেড়েছে একমাত্র ইন্টারনেট পরিষেবা। তাই আমাদের সরকার অন্যভাবে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে। হতে টাকা না দিয়ে বিনামূল্যে খাদ্য, ওষুধ, গ্যাস, ব্যাংকের কিস্তির উপর মোরাটোরিয়াম ইত্যাদি দেয়া হল। সাধারণ জ্বরের ওষুধ যেমন, কোভিডের জ্বরের ওষুধ নয়, তেমনই অন্যান্য মন্দা এবং এবারের মন্দা এক নয় ।

ভারত সরকার আরও একটা কড়া পদক্ষেপ নিয়েছিল ওই সময়। সেটা হল কড়া ভাবে লকডাউন পালন করা। জিডিপি হ্রাস পাবে জেনেও, সরকার দুটো পয়সা বা সংখ্যার জন্য নিজের দেশবাসীকে মৃত্যু মুখে ঠেলে দেয়া উচিত মনে করেন নি। কারণ মানবসম্পদ আগামী দিনের বৃদ্ধির মূল ইঞ্জিন মনে করে সরকার। একজন মানুষের মৃত্যু একটি পরিবারের স্বপ্ন অন্ততঃ দুই যুগের জন্য পিছিয়ে দিতে পারে। সরকার বিনিয়োগ করে গেছে  অসুধ, ভ্যাকসিন,  গবেষণা এবং তথ্যপ্রযুক্তিতে। এর ফলে ২০২০-২১ অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে দেশের জিডিপি বড় রকমের হ্রাস পেলেও, সরকার বোঝে আগামী দিনের জন্য এটুকু ত্যাগ দেশকে করতে হবে। প্রসঙ্গত, আজ যখন পৃথিবীর ৪৪ টি উন্নতদেশের মধ্যে ৩৭ টি মন্দা এবং মুদ্রাস্ফীতির সাঁড়াশি চাপে দিশাহীন, তখন আমাদের দেশে বৃদ্ধির হার ৭%-এর উপর।

কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্বঅর্থনীতি সচল হতেই দ্বিতীয় সমস্যা শুরু হয়। সেটা হল মুদ্রাস্ফীতি। যে সব দেশে মুদ্রাস্ফীতি কখনো ২% থেকে ৩%-এ যায় না,তাঁরা আজ দুই অঙ্কে মুদ্রাস্ফীতিতে পৌঁছে গিয়েছে। কারণ বাজারে যে পরিমাণ পণ্য এবং পরিষেবা আছে, তাঁর চেয়ে অনেক বেশী মুদ্রা ছেড়ে দিয়েছে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলিতে। পণ্য ও পরিষেবার চেয়ে মুদ্রার পরিমাণ বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই জিনিসের দাম বাড়বে। তাই এখন সবাই সুদের হার বাড়াচ্ছে,বাজারে মুদ্রার জোগান কমাতে, একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। আগেই বলেছি, যদিও রিজার্ভ ব্যাংকও সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করেছে।

ভারতে মুদ্রাস্ফীতি ৭%-এর কিছু বেশি হলেও, তাঁর কারণ মূলতঃ বিদেশ থেকে আসা সামগ্রী। যেমন জ্বালানি, সোনা এবং খাবারের তেল। যার জন্য আমরা বহির্বিশ্বের উপর নির্ভরশীল। দেশীয় পণ্যের মুদ্রাস্ফীতি নাগালের মধ্যেই। গত আর্থিক বর্ষে প্রায় অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি সূচক বা মানদন্ডে, ভারত নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম 
স্থিতিশীল অর্থব্যাবস্থা হিসেবে ঘোষণা করেছে। জিডিপি বৃদ্ধির হারে আমরা উন্নত দেশগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ, ব্যাংকের মোট লাভ ছাড়িয়েছে এক লক্ষ কোটি, NPA পাঁচ বছরে সর্বনিম্ন, পণ্য রপ্তানি সর্বকালীন রেকর্ড $৪০০ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে, বিদেশী মুদ্রার ভান্ডার ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ তথা $৬০০ বিলিয়ন, প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ। 

দশটি ক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদনে সরকার বিশেষভাবে জোর দিচ্ছে। যার মধ্যে আছে কেমিকাল ব্যাটারি সেল (ACC), ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য, অটোমোবাইল, অসুধ, টেলিকম, বস্ত্র, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, বিভিন্ন উচ্চ সৌরবিদ্যুৎ সরঞ্জাম, AC-LED, ইস্পাত। এছাড়া চিপ ম্যানুফেকচারিং ক্ষেত্রে পৃথিবীর গন্তব্য হিসেবে দেশকে তুলে ধরার জন্য সরকার ৭৬০০০ কোটি অনুদান হিসেবে শুধু চিপ ডিজাইনের জন্য বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছে।

এত কিছুর পরেও কি রক্ষে আছে এই বিশ্বায়নের যুগে? একদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ছে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে উধাও সূর্যমুখী তেল, লাতিন আমেরিকার সোয়াবিন তেল ব্যাবহার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ী চালাতে। ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি কমিয়েছে। সঙ্গে মুদ্রার সমুদ্র তৈরি করে দিয়েছে মুদ্রাস্ফীতি। চিনের ঋণের চাপে পৃথিবীর আধা অন্ধকার দেখছে। স্বাভাবিক কারণেই আবার আসছে মন্দা। আর্থিক বিশ্লেষকরা বলছে এর প্রভাব হবে ২০০৮-এর চেয়েও দীর্ঘ সময়ের জন্য। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের সুদের হার বাড়ানোতে সারা পৃথিবীর স্টক মার্কেট থেকে টাকা বের করে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি এবং বিনিয়োগ শুরু করে মার্কিন মুলুকের বন্ডে। যথারীতি সব দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন শুরু। এবং এক্ষেত্রেও সবচেয়ে কম ভারত। কিন্তু কেন ভারত সবচেয়ে কম?

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুদের হার বাড়াতেই ভারত কিছু এমন ব্যাবস্থা শুরু করে যাতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন আটকানো যায়। সোনার আমদানীর উপর কর চাপানো হয়, যাতে আমদানি কমে। সঙ্গে বাজারের গতবছরের সঞ্চিত ডলার ছেড়ে টাকা ঘরে তুলে নেয়। আগামীদিনে আরও $১০০ বিলিয়ন ডলার বাজারে ছেড়ে টাকা ঘরে তোলার পরিকল্পনা আছে। এছাড়া অনাবাসীদের ভারতীয় ব্যাংকে আরও বেশী টাকা জমা করতে উৎসাহ দিতে সেই জমা টাকার উপর ব্যাংকের CRR বা SLR জমা পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ ছাড় দেওয়া হয়েছে সাময়িকভাবে, যাতে ব্যাংক ওই টাকা বাজারের খাটাতে পারে এবং সেই অনুযায়ী অনাবাসীদের টাকা জমা করতে উৎসাহিত করতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যাংকগুলিকে অনাবাসী জমার ক্ষেত্রেও সুদের যে ঊর্ধ্বসীমা ছিল, তা রিজার্ভ ব্যাংক সরিয়ে নিয়েছে। সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ হল, বিদেশী আর্থিক সংস্থাগুলির আমাদের দেশীয় বন্ড কেনার ব্যাপারে কিছু ছাড় দেওয়া। আগে বিদেশী সংস্থাগুলি ৫, ১০ এবং ৩০ বছরের বন্ডে বিনিয়োগ করতে পারত। সরকার এখন ৭ এবং ১৪ বছরের বন্ডেও বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছে। এছাড়া যে সব বন্ডের ম্যাচুরিটি ২০২৯ বা ২০৩৬-এ, সেখানও তারা বিনিয়োগ করতে পারবে। তারা আগে একবছরের কম সময়ের বন্ডে ৩০% বিনিয়োগ করতে পারত। এখন সেই সীমাও তুলে নেওয়া হল। তাছাড়া ভারতীয় কোম্পানি আগে বিদেশের বাজারের থেকে $৭৫০ মিলিয়ন টাকা বন্ড মারফত আনতে পারত। নতুন নিয়ম অনুযায়ী তারা $১.৫ বিলিয়ন টাকা তুলতে পারবে। এই প্রতিটি পদক্ষেপই ডলারের তুলনায় টাকার চাহিদা বাড়িয়ে টাকাকে আরও শক্তিশালী করার পদক্ষেপ। কিন্তু এগুলো সবই অস্থায়ী।

সঙ্গে আছে কিছু স্থায়ী পদক্ষেপ, যা এককথায় আর্থিক ব্যাবস্থায় বিপ্লব। এতদিন আমরা যে কোনও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরশীল ছিলাম। তাই আমরা মধ্যপ্রাচ্যর থেকে তেল কিনি কিম্বা তাদের গম বেচি, দুই ক্ষেত্রেই দর বাড়বে ডলারের এবং কমবে আমাদের মুদ্রার দাম। এটা সব মুদ্রার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একসময় দেড় ডলারের সমান ছিল এক ইউরো, আজ ইউরোপের ১৮ দেশের সাধারণ মুদ্রাও ডলারের কাছে আত্মসমর্পণ করে ইউরো ডলার এক দাম হয়ে গেছে। কিন্তু আলো দেখাচ্ছে ভারতীয় প্রযুক্তিতে তৈরী UPI সিস্টেম, যা চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে SWIFT সিস্টেমকে। আগামী দিনে রাশিয়া এবং বহু এশিয়ান দেশ এই UPI ব্যাবহার করবে এবং টাকায় ব্যাবসা করবে। বাড়বে ভারতীয় টাকার দাম।

পৃথিবীর ৪৪টি উন্নতদেশের মধ্যে ৩৭ টি যখন মন্দার কবলে, তখন ভারতের অর্থব্যাবস্থা একমাত্র পৃথিবীর কাছে আশার আলো। এর কারণ গত আট বছরের ক্রমাগত হতে থাকা আর্থিক এবং প্রশাসনিক সংস্কার। জনধন, সাধারণ বীমা, দুর্ঘটনা বীমা, স্বাস্থ্যবীমা, পরিকাঠামো উন্নয়ন, বিভিন্ন PLI এবং DLI প্রকল্প, নোটবন্দি, GST, IBC, RERA, শ্রমিক আইন, মুদ্রালোন, বহু ব্যাঙ্কিং সংস্কার দেশের অর্থব্যাবস্থাকে মজবুত করেছে। অতিমারীর সময়ে অর্থমন্ত্রক এবং রিজার্ভ ব্যাংকের বিভিন্ন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত দেশকে বড় রকমের বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। সামনে পৃথিবীব্যাপী বড় মন্দা আসছে একটা বড় সময়ের জন্য। কিছু প্রভাব পড়বেই। কিন্তু আমরা প্রস্তুত। একসময় পোলিও, বসন্ত  ভ্যাকসিন আসার ৪০ বছর পর আমরা সেই ভ্যাকসিন পেতাম। আজ আমরা সবার আছে কোভিড ভ্যাকসিন দিয়েছি পৃথিবীর ১৬% মানুষকে। এ এক নতুন ভারত। আর্থিক অতিমারী মোকাবিলাতেও আমরা এখনো সফল এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত।

 

 

 

 

 

(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তনী এবং একজন চার্টার্ড ফিনান্সিয়াল অ্যানালিষ্ট : বর্তমানে বিশ্বব্যাংক এবং এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রকল্পের পরামর্শদাতা )

Share this article
click me!