১৭৫৭ সালের কাঠামোতেই এখনও গড়ে ওঠে শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফের দুর্গা প্রতিমা, জেনে নিন সেই পুজোর ইতিহাস

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে পুজো শুরু করলেন নবকৃষ্ণ। পুজোর বিধি তিনি নিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সভাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানের কাছ থেকে। এই দুর্গাপুজো এখন বড় তরফের পুজো নামে খ্যাত। 

Web Desk - ANB | Published : Sep 29, 2022 7:50 AM IST / Updated: Sep 29 2022, 02:33 PM IST

১৭৫৭ সালে দুর্গাপুজো শুরু করলেন নবকৃষ্ণ। পুজোর বিধি তিনি নিয়েছিলেন কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের সভাপণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চাননের কাছ থেকে। তর্কপঞ্চাননের পরামর্শমতো সাত্ত্বিক মতে পুজো হবে বলে ঠিক করেন তিনি। মনের মতো করে দেবীকে গড়েছিলেন তিনি। সেই পুজো শোভাবাজার রাজবাড়ির মূল পুজো হিসেবে পরিচিত। যা লোকমুখে এখন বড় বাড়ির পুজো বা বড় তরফের পুজো নামে বিখ্যাত। লিখেছেন, সংবাদ প্রতিনিধি অনিরুদ্ধ সরকার।


শতাব্দী প্রাচীন কাঠামোতেই হয় পুজো-
১৭৫৭ সালে প্রথম বছর দুর্গাপুজোর সময়ে যে কাঠামো তৈরি হয়েছিল সেই কাঠামোর উপরেই আজও মূর্তি গড়া হয় শোভাবাজার রাজবাড়ির এই দুর্গাপ্রতিমার।বড় তরফের কাঠামো পুজো হয় রথের দিন। দেবীর যে পা সিংহের উপরে থাকে, তার বাঁশটি পুজো করে কুমোরকে দিয়ে দেওয়া হয় প্রতিমা নির্মাণের জন্য।বড়তরফের তৃতীয়ার দিন দেবীকে চৌকিতে তোলার পরে শুরু করা হয় সাজ। ষষ্ঠীর দিন নবপত্রিকাকে গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয় স্নান করাতে। তাঁর মাথায় ধরা হয় ভেলভেট আর সোনার সুতোয় কারুকাজ করা ছাতা।

দেবীর সাজসজ্জা-
শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফের দেবী মূর্তি একচালার। ডাকের সাজে দেবীকে সাজানোটা প্রথম থেকেই রীতি এ বাড়িতে। আগে জার্মানি থেকে অর্ডার দিয়ে ডাকের সাজ আনানো হত। সেই প্রথা বহুদিন আগে বন্ধ হওয়ার পরে কৃষ্ণনগরের শিল্পীরাই পরম যত্নে দেবীর সাজ বানিয়ে দেন। তবে দুই তরফেই প্রথম থেকেই পুজোর পোশাক হয় রাজস্থানী ঘরানার। বড় তরফের সিংহের গায়ের রং সাদা। মুখ ঘোড়ার মতো। ছোট তরফের সিংহের চেহারা আলাদা হয়। আগে বিদেশ থেকে রুপোর পাত এনে সিংহের গা মুড়ে দেওয়া হত প্রতিবছর। সেই পাত-সহই প্রতিমা বিসর্জন হত। এখন আর তা সম্ভব হয় না। তবে সিংহের গায়ের রং এখনও প্রথা মেনে রুপোলিই রাখা হয়। ষষ্ঠীর দিন দেবীকে গয়না পরান পরিবারের সদস্যরা। রুপোর অস্ত্রশস্ত্র ওঠে দেবীর হাতে।





পুজো পদ্ধতি - 
বড়তরফে সন্ধি পুজোয় কখনও দেওয়া হয় চাঁপা ফুল রংয়ের শাড়ি, কখনও বা ভোরের আকাশের মতো নীল শাড়ি। দুর্গাপুজোর সময়ে বড় তরফের গৃহদেবতা রাধা-গোবিন্দজিউকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়।সন্ধিপুজোর সূচনা হত কামান দেগে।  শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত সে শব্দ। বড় তরফে আগে পুজোর তিন দিন ছাগবলি দেওয়া হত। কিন্তু একবার বলির সময়ে হাঁড়িকাঠ থেকে পালিয়ে একটি পাঁঠা সোজা রাধাকান্তদেবের কাছে এসে আশ্রয় নেয়। আশ্রয়প্রার্থীকে আর মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে রাজি হননি রাধাকান্ত দেব। কিন্তু রক্ত ছাড়া যেহেতু শক্তির আরাধনা হয় না, তাই পণ্ডিতদের বিধানে তিনি নিজের আঙুল কেটে রক্ত দেন। এরপর থেকে পাঁঠার বদলে মাগুর মাছ বলি দেওয়া শুরু হয়। অষ্টমী-নবমীর দিন এ বাড়িতে চালকুমড়ো, আখ আর মাগুর মাছ বলি দেওয়া হয়


দেবীর 'সিধে'-
দেবীকে 'সিধে' দেওয়া হয়। সিধের মধ্যে থাকে চাল, ডাল, আনাজপাতি, মশলা, মানকচু, রুইমাছ, সৈন্ধব লবন, শাড়ি ও ধুতি।

কনকাঞ্জলি প্রথা-
বাড়ির মেয়েরা বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় যেমন কনকাঞ্জলি দেয়, এ বাড়ির দুর্গাও কৈলাশে ফেরার সময়ে কনকাঞ্জলি দেন। শোভাবাজার রাজবাড়ির দুই তরফেই এই প্রথা প্রচলিত আছে। আগে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠা মহিলারা আঁচল পেতে সেই কনকাঞ্জলি নিতেন। সোনা রূপোর মুদ্রা, চাল দেওয়া হত তাতে। সেই দিন আর নেই।এখন দেওয়া হয় টাকা-পয়সা আর চাল। দেবীর হয়ে পুরোহিত পিছন দিকে এগুলি ফেলেন। বাড়ির বড়রা প্রতিমার পিছনে দঁড়িয়ে সেগুলি গ্রহণ করেন। প্রতিমা বিসর্জন দিতে বাড়ি থেকে রওনা করার সময় তলোয়ার এবং ঘোড়া পূজা করা হয়। মনে করা হয় এই তলোয়ারই সারা বছর পরিবারকে রক্ষা করবে বিপদ-আপদ থেকে।


দশমীর রেওয়াজ-
আগে নিয়ম মেনে দশমীতে নীলকণ্ঠ পাখি ছাড়া হলেও এখন সেই প্রথাও বন্ধ। তার বদলে বেলুনে শোলার তৈরি নীলকণ্ঠ বসিয়ে উত্তর দিকে মুখ করে সেই বেলুন ছেড়ে দেয় বড় তরফ।

 
শ্রী আনার রেওয়াজ-
বড়তরফ থেকে শোভাযাত্রা বেরতো ‘শ্রী’ আনতে। পাল্কিতে বসিয়ে প্রধান পুরোহিতের বাড়িতে গড়া ‘শ্রী’ আনা হত ঠাকুরদালানে। সঙ্গে থাকত বল্লমধারী পেয়াদা এবং বাজনদারের দল। এখনও ঢাকঢোল বাজিয়ে পুরোহিতের বাড়ি থেকে এই 'শ্রী' আসে। ব্রাহ্মণ বাড়ি নয় বলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে দেবীকে অন্নভোগ দেওয়া হয় না।

ভোগবৃত্তান্ত - 
বড় তরফে সপ্তমীর দিন দেবীকে ভোগ হিসেবে দেওয়াহয় ‘আগা’। বিরাট কাঁসার থালায়চুড়ো করে শুকনো চাল সাজিয়ে তার উপরে সাজিয়ে দেওয়া হয় মঠ গোটা পান ও সুপারি। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীতে তেত্রিশটি থালায় করে চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। এছাড়াও দেবীকে দেওয়া হয় রাধাবল্লভী, সিঙ্গারা, খাস্তাকচুরি, জিলিপি, পদ্মনিমকি এবং রকমারি ফল। পুজোর আগে হালুইকর এসে ভিয়েন বসান। যাবতীয় মিষ্টি তৈরি হয় বাড়িতেই। রাতে দেবীকে দেওয়া হয় মাখন-মিছরির ভোগ


আরও পড়ুন-
বাঈজি নাচ থেকে বলড্যান্স, নবাব সিরাজের অর্থ পেয়ে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গাপুজোয় এসেছিল ইংরেজরেজদের বৈভবের ছাপ
স্বৈরাচারী রাজার বিনাশের পর কীভাবে শুরু হয়েছিল সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের বাড়ির দুর্গাপুজো?
ঢাকের তালে সাড়ম্বরে উদ্বোধন হল চালতাবাগান লোহাপট্টির দুর্গাপুজোর মণ্ডপ, আনন্দে মাতলেন সুদীপ,শ্রীজাত, শশী পাঁজা

Read more Articles on
Share this article
click me!