বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোর দুপুরে ঠিক ১২টার সময় ভোগ দিয়ে ভোগারতি হয় এবং রাতে ৮ টার পরে ভোগ দেওয়া হয় মা দুর্গাকে। সকালের বাল্যভোগ দেওয়া হয় পূর্বাহ্নের পুজোর সময়।
বেলুড় মঠের (Belur Math) দুর্গাপুজোয় (Durga Puja) অষ্টমীর (Ashtami) দিন আসে কালীঘাট (Kalighat) থেকে বলির মাংস। এক দেব-দেবীর কাছে উৎসর্গ করা প্রাসাদ যখন আবার অন্য দেব-দেবীর পুজোতে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় তখন তা 'মহাপ্রসাদ' (Maha Prashad) হয়ে ওঠে। যেমন পুরীতে (Puri) জগন্নাথ দেবের (Jagannath Temple) প্রসাদ মা বিমলাকে নিবেদন করার পর তা 'মহাপ্রসাদ' হয়ে যায়। দশটি থালায় করে মা দুর্গার উদ্দ্যেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হয়। যার মধ্যে আটটিতে থাকে আমিষ পদ আর দুটিতে থাকে নিরামিষ পদ। মায়ের জন্য মেদিনীপুর থেকে আনানো হয় বিশেষ 'গয়না বড়ি'। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের (Sri Ramkrishna) কথা, "মা শতমুখে খান"। এই ভাবনাকে সবসময় বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করে চলেছেন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসীরা। ঠাকুর নিজেও খেতে ভালোবাসতেন। আর স্বামীজীর (Swamiji) খাওয়াদাওয়া! একবার তো বাইরে থেকে দীর্ঘদিন বাদে মঠে ফিরেছেন, মঠের সদর দরজা বন্ধ, তো প্রাচীর টপকে মঠের ভেতর হাজির। হাত ধুয়ে খেতে বসে গেলেন আর বললেন, "জলদি খাবার আন।" সন্ন্যাসীদের সঙ্গে বসে জমিয়ে খিচুড়ি খেলেন। মঠের প্রাণপুরুষদের ইচ্ছেতেই বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোয় মা দুর্গাকে পুজোর সময় হরেকরকম পদ দেওয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। মঠের খিচুড়ি ভোগ বিষয়ে বেলুড় মঠের এক সময়ের অধ্যক্ষ স্বামী বিরাজানন্দ এক লেখায় লেখেন, "শুধু খিচুড়ির পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবস্থা করা হবে। তাতেই শাক-সবজি যা কিছু দেবে। অন্য তরকারি, মিষ্টান্ন কিছু দরকার নেই।"
বেলুড় মঠের দুর্গাপুজোর দুপুরে ঠিক ১২টার সময় ভোগ দিয়ে ভোগারতি হয় এবং রাতে ৮ টার পরে ভোগ দেওয়া হয় মা দুর্গাকে। সকালের বাল্যভোগ দেওয়া হয় পূর্বাহ্নের পুজোর সময়। অষ্টমীর দিন অষ্টমী তিথি বারোটার আগে ছেড়ে গেলে অষ্টমীর মধ্যেই একবার ভোগ দেওয়া হয় তারপর আবার যথারীতি দুপুরের ভোগ দেওয়া হয়। দুপুর ও রাতে ভোগ নিবেদনের সময় থালার সামনে আসন পেতে দেওয়া হয় এবং নারায়ণের ভোগের উপর তুলসী ও মা দুৰ্গা সহ সকলের ভোগে দেওয়া হয় বেলপাতা।
বেলুড় মঠের দুৰ্গা পুজোতে দশটি থালায় করে মা দুর্গার উদ্দ্যেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হয়। যার মধ্যে আটটি থালায় থাকে বিভিন্ন আমিষ পদ আর অন্য দুটি থালায় থাকে নিরামিষ পদ। নিরামিষ ভোগ দেওয়া হয় নারায়ণ ও শিবের জন্য। আমিষ ভোগের প্রধান বড় থালাটি মা দুর্গার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। আর অন্য থালাগুলির ভোগ দেওয়া হয় লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ, নবপত্রিকা ও সিংহের জন্য। মহিষাসুরের জন্যও ভোগ নিবেদন করা হয়।
বেলুড় মঠে যখন আলাদাভাবে লক্ষ্মী ও সরস্বতী পুজো হয় তখন কিন্তু সেই ভোগের সময় লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে আমিষ দেওয়া হয় না। শুধু দুর্গা পুজোর সময় লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে আমিষ দেওয়া হয়। তার কারণ তাঁরা দুর্গাপুজোর সময় মায়ের সহচরীরূপে উপস্থিত থাকেন। সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর সকালে মায়ের ষোড়োশপচারে পুজোর পর মা'কে দেওয়া হয় বাল্যভোগ। এই বাল্যভোগে থাকে পিতলের এক বড় হাঁড়ি খিচুড়ি ও গোটা ইলিশ মাছ ভাজা। ইলিশ মাছে মশলা দেওয়া হয়। এই বাল্যভোগ কেবলমাত্র মা দুর্গার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। সকল দেবী, দেবতা, বাহন ও অঙ্গ দেবতার পুজোতে নৈবেদ্যর আলাদা আলাদা আয়োজন থাকে। প্রত্যেকের নৈবেদ্য নিবেদনের পর জায়গাটি মুছে অন্য নৈবেদ্য আনা হয়।
আরও পড়ুন- করোনা আবহে এবার ভক্তশূন্য বেলুড় মঠে নেই আড়ম্বর কেবল বিধি মেনে সম্পন্ন হল কুমারী পুজো
দ্বিপ্রহরিক অন্নভোগে মাকে নিবেদন করা হয় গোবিন্দভোগ চালের সাদা ভাত, বাসমতী চালের পোলাও, খিচুড়ি এবং পরমান্ন বা পায়েস। এই চালগুলি বাছাই ও ঝাড়াইয়ের কাজ চলে মহালয়ার দিন থেকে। মঠের নবীন ব্রহ্মাচারীরা এই দায়িত্ব নিয়ে থাকেন। এছাড়া অন্নভোগের থালায় থাকে আলু, পটল, কুমড়ো, উচ্ছে ও কাঁচকলা- এই পাঁচ রকমের সেদ্ধ সবজি। মাকে দেওয়া হয় পাঁচ রকমের ভাজা। যার মধ্যে থাকে আলু, পটল, বেগুন, উচ্ছে ও বড়ি। মায়ের জন্য মেদিনীপুর থেকে আনানো হয় বিশেষ 'গয়না বড়ি'। বাজারে প্রাপ্ত সবধরনের শাক-সবজি দিয়ে মায়ের জন্য তরকারি ও ডালনা প্রস্তুত করা হয়। ফুলকপি, বাঁধাকপি থেকে এঁচোড়, মোচা আরও হরেক রকমের সবজি দিয়ে বিভিন্ন পদ বানানো হয়। তরকারিগুলি সুন্দরভাবে আলাদা আলাদা বাটিতে সাজিয়ে নিবেদন করা হয়।
একসময় মাটির বাসনে মায়ের ভোগ নিবেদন করা হত। পরবর্তীকালে এই নিয়ম বদলানো হয় ও মাটির পরিবর্তে বড় কাঁসার থালা বাটিতে ভোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মায়ের আমিষ ভোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মাছ ও মাংস। কমপক্ষে পাঁচ রকমের মাছের পদ নিবেদন করা হয় মা'কে। যার মধ্যে থাকে রুই, চিংড়ি, ভেটকি, ইলিশ আর সরপুঁটি। এই পাঁচধরনের মাছ ছাড়াও যদি বাজারে অন্য মাছ পাওয়া যায় তো সেই মাছের পদও ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়।
অষ্টমীর দিন সন্ধিপুজোতে মাকে দেওয়া হয় বিশেষ 'বড়ভোগ'। যার মধ্যে সবরকমের অন্ন ভোগ, তরকারি, ফল মিষ্টি ও মাছের নানা পদ থাকে। মায়ের সামনে আখ, চালকুমড়ো ও কলা বলি দেওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। বেলুড় মঠের পুজোয় অষ্টমীর দিন আসে কালীঘাট থেকে বলির মাংস। মা-র বড়ভোগের সঙ্গে ওই বলির মাংস নিবেদন করা হয়। বেলুড় মঠের প্রথম দুর্গাপুজোয় পশুবলিকে কেন্দ্র করে স্বামীজীর সঙ্গে সারদা মা-এর বিরোধ হয়। স্বামীজী ছিলেন বলির পক্ষে আর সারদা মা ছিলেন বিপক্ষে। শেষে সারদা মার নির্দেশে বেলুড় মঠে পশুবলি বন্ধ হয়। আর দুর্গাপুজোর পাঁঠা বলির মাংস আসে কালীঘাট থেকে।
দুর্গাপুজোর সন্ধিপুজো ছাড়াও কালীপুজো ও ফলহারিণী পুজোর দিন কালীঘাটে দেবীমাকে উৎসর্গ করে পাঁঠা বলি দেওয়া হয় আর সেই প্রসাদী পাঁঠার মাংস পরে মঠে নিয়ে এসে রান্না করে মাকে ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। এক দেব-দেবীর কাছে উৎসর্গ করা প্রাসাদ যখন আবার অন্য দেব-দেবীর পুজোতে ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় তখন তা 'মহাপ্রসাদ' হয়ে ওঠে। যেমন পুরীতে জগন্নাথ দেবের প্রসাদ মা বিমলাকে নিবেদন করার পর তা 'মহাপ্রসাদ' হয়ে যায়।
বেলুড় মঠে পুজোর ভোগ মঠেই প্রস্তুত করা হয়। মহালয়ার দিন থেকেই এর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। প্রায় দু-তিন হাজার নারকেল নাড়ু মায়ের জন্য তৈরি করা হয়। এছাড়া মুড়কি ও অন্য বেশ কয়েকরকম উপাদেয় মিষ্টি বানানো হয়। মায়ের নৈবেদ্যর জন্য সব ঋতুর ফলই থাকে। আপেল, কমলালেবু, নারকেল থেকে আঙুর। এসবের পাশাপাশি মাকে দেওয়া হয় কাজু কিশমিশ, খেজুর ও আমসত্ত্ব।
রাতে মাকে কী কী ভোগ দেওয়া হয়
দুর্গাপুজোর দিনগুলিতে রাতে মা-কে নিবেদন করা হয় লুচি, ছোলার ডাল ও মুগের ডাল। তিন রকমের তরকারি ও পাঁচ রকমের ভাজাও দেওয়া হয়। এছাড়া থাকে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি , ক্ষীর ও রাবড়ি। রাতে মায়ের ভোগে কোনও আমিষ পদ থাকে না। রাতের সব ভোগই হয় নিরামিষ। দশমীর দিন মায়ের সামনে নিরঞ্জন কৃত্য ভোগ হিসেবে দেওয়া হয় দধিকর্মা। যার মধ্যে মূলত থাকে চিঁড়ে ও দই। এছাড়া তাতে দেওয়া হয় কাজু, কিশমিশ, নানান ধরনের ফল, কলা, নাড়ু, সন্দেশ এসব। দুর্গাপুজোর দিনগুলি ছাড়াও মায়ের নামে প্রতিদিন মঠে খিচুড়ি ভোগ বিতরণ করা হয়। ভোগ রান্নার ঘরেই মায়ের ছবির সামনে এই ভোগ নিবেদন করে আরতি করা হয়। তারপর দর্শনার্থী ও ভক্তদের থালায় তা তুলে দেওয়া হয় মায়ের মহাপ্রসাদ রূপে। চাল, ডাল ও সব রকম তরকারি দিয়েই এই খিচুড়ি প্রস্তুত করা হয়। সঙ্গে থাকে চাটনি। আর যেটা থাকে তা হল মা অন্নপূর্ণার অপার আশীর্বাদ।