Durga Puja- কেন বন্ধ হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো

যশোর থেকে কলকাতা শহরে এসে পঞ্চানন কুশারী তৎকালীন সুতানুটি অঞ্চলে গঙ্গার ঘাটে ব্যবসায়ীদের পুজার্চনা করতেন। আর সে কারণেই লোকে তাঁকে ঠাকুরমশাই বলে ডাকতে শুরু করে। ক্রমে তিনি পঞ্চানন কুশারী থেকেও পঞ্চানন ঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। 

Asianet News Bangla | Published : Oct 11, 2021 9:24 AM IST / Updated: Oct 11 2021, 03:05 PM IST

ঠাকুরবাড়িতে (Thakur Bari) দ্বারকানাথ এক সময় জাঁকিয়ে দুর্গাপুজো (Durga Puja) করতেন। কিন্তু, রামমোহনের (Rammohan) প্রভাবে মূর্তিপুজোর বিরোধী হয়ে ওঠেন। তবে নিজে পুজোপাঠের থেকে দূরে সরে গেলেও ঠাকুরবাড়িতে পুজোপার্বনের কখনও কোনও বিরোধিতা করেননি। অথবা তা তুলেও দেননি। জানা যায়, দ্বারকানাথ (Dwarkanath Tagore) বিদেশেও নিয়মিত গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছোটবেলায় পিতার মতোই নিষ্ঠাবান ছিলেন। পিতামহীর জন্য ফুলের মালা গেঁথে দিতেন। দিদিমা অলকাসুন্দরীর সঙ্গে স্নানের পর ছাদে উঠে নিত্য সূর্যপ্রণাম করতেন। সেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও হয়ে যান মূর্তিপুজোর বিরোধী। আর পুজোর কটা দিন চলে যেতেন হিমালয়ে। তারপর একদিন তুলে দিলেন দুর্গাপুজো। লিখছেন অনিরুদ্ধ সরকার

যশোর থেকে কলকাতা শহরে এসে পঞ্চানন কুশারী তৎকালীন সুতানুটি অঞ্চলে গঙ্গার ঘাটে ব্যবসায়ীদের পুজার্চনা করতেন। আর সে কারণেই লোকে তাঁকে ঠাকুরমশাই বলে ডাকতে শুরু করে। ক্রমে তিনি পঞ্চানন কুশারী থেকেও পঞ্চানন ঠাকুর নামেই বেশি পরিচিত হয়ে ওঠেন। আর সেই থেকে তাঁর ও উত্তরসূরীদের পদবী কুশারী থেকে হয়ে যায় 'ঠাকুর'। 

দেখতে দেখতে পঞ্চানন ঠাকুরের পরবর্তী প্রজন্ম শহর কলকাতায় প্রভূত সম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠেন। একটা সময় পঞ্চানন ঠাকুরের দুই নাতি নীলমণি ঠাকুর এবং দর্পনারায়ণ ঠাকুরের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ তৈরি হয়। বিবাদ এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছায় যার জেরে নীলমণিঠাকুর ঠাকুর বংশের গৃহদেবতা লক্ষ্মী এবং শালগ্রাম শিলা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে তিনি কলকাতার মেছুয়াবাজার অর্থাৎ আজকের জোড়াসাঁকো অঞ্চলে এক সুবিশাল বাড়ি নির্মাণ করেন। এই নীলমণিঠাকুরই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পত্তন করেছিলেন। আর তিনিই ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজোরও সূচনা করেছিলেন। তবে ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো রাজকীয় আকার ধারণ করেছিল নীলমণি ঠাকুরের নাতি প্রিন্স দ্বারকানাথের হাত ধরে।

আরও পড়ুন- নীলমণি ঠাকুরের আমলে দুর্গাপুজো শুরু হলে ও জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ধুমধাম শুরু দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলেই

দ্বারকানাথ পারিবারিক আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে জগদ্ধাত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী পুজোর বেশ সুখ্যাতি ছিল। কিন্তু দ্বারকানাথ রামমোহনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে মূর্তি পুজোর বিরোধী হয়ে ওঠেন।  

উইলিয়ম অ্যাডাম সাহেব ছিলেন কলকাতায় একেশ্বরবাদী নামে একটি সমিতির প্রধান। অ্যাডাম স্মিথের বন্ধু ছিলেন রামমোহন। এই একেশ্বরবাদী সমিতির অধিবেশনে বসত প্রতি রবিবার। ১৮২১ সাল থেকে সেই সমিতির অধিবেশনে প্রতি রবিবার দ্বারকানাথ উপস্থিত থাকতেন। রামমোহন ও অ্যাডাম সাহেবের একেশ্বরবাদ প্রচারের জন্য দ্বারকানাথ মোটা টাকা চাঁদা দেওয়া শুরু করেন। একেশ্বরবাদী ধারণা ও আকর্ষণের চেয়ে রামমোহনের প্রভাব ছিল তখন দ্বারকানাথের উপর সবচেয়ে বেশি। দ্বারকানাথ রামমোহনকে মানতেন।

আরও পড়ুন- দুর্গাপুজোর ঘরোয়া টোটকাতেই মিলবে জীবনের সমস্যা থেকে মুক্তি

আর এর জেরে যে মানুষ এক সময় রোজ লক্ষ্মী-জনার্দন শিলার পুজো করতেন। ঠাকুরের হোম-তর্পণ-জপ-যজ্ঞ এসব করতেন তিনি হঠাৎ করে ঠাকুরের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দেন। দ্বারকানাথ নিত্যপুজো আরতি যাগযজ্ঞের জন্য পৃথক পৃথক আঠেরো জন পুরোহিত নিয়োগ করেন। পারিবারিক পুজোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ কমে যায় দ্বারকানাথের। দ্বারকানাথ নিজে পুজোপাঠের থেকে দূরে সরে গেলেও ঠাকুরবাড়িতে পুজোপার্বনের কখনো কোনও বিরোধিতা করেননি। অথবা তা তুলেও দেননি। জানা যায়, দ্বারকানাথ বিদেশেও নিয়মিত গায়ত্রী মন্ত্র জপ করতেন। 

দুর্গাপুজোর সময় একবার দেবেন্দ্রনাথ পিতামহের আমন্ত্রণপত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলেন রামমোহনের কাছে। দেবেন্দ্রনাথের বয়স তখন সবে বারো ছুঁয়েছে। দেবেন ঠাকুর বুঝতে পেরেছিলেন রামমোহন প্রতিমাপুজোর বিরোধী এবং ঠাকুরবাড়ির আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে খুব বিস্মিত হয়েছেন। দেবেন ঠাকুর আরও দেখলেন রামমোহন নিমন্ত্রণপত্রটি প্রত্যাখ্যান করলেন না আবার সরাসরি সেটি গ্রহণও করলেন না, তিনি পুত্র রাধাপ্রসাদের কাছে দেবেন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দিলেন। রাধাপ্রসাদ পিতার হয়ে ঠাকুরবাড়িতে গেলেন পুজো দেখতে। এই ঘটনা সরাসরি প্রভাব ফেলল দেবেন্দ্রনাথের মনে। পঁচিশ বছরের তরুণ দেবেন্দ্রনাথ তাই ব্রাহ্মধর্মকে দীক্ষার ধর্মে রূপায়িত করে আদি ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা করলেন।

আবার এই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছোটোবেলায় পিতার মতোই নিষ্ঠাবান ছিলেন। পিতামহীর জন্য ফুলের মালা গেঁথে দিতেন। দিদিমা অলকাসুন্দরীর সঙ্গে স্নানের পর ছাদে উঠে নিত্য সূর্যপ্রণাম করতেন। আবার বিদ্যালয় যাওয়ার পথে ঠনঠনিয়ায় সিদ্ধেশ্বরী কালিকাদেবীকে প্রণাম করতে ভুলতেন না। বাড়িতে জাঁকিয়ে সরস্বতী পুজো করেছিলেন। সেই বিশাল প্রতিমাকে বিসর্জনের সময় বাড়ির দুয়ার দিয়ে বার করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল সবাইকে। দেবেন ঠাকুরের বয়স তখন সবে বাইশ। জোড়াসাঁকোতে তখন মহা সমারোহে দুর্গাপুজোর আয়োজন চলছে, দেবেন্দ্রনাথ তখন তাঁর অনুগামীদের নিয়ে বাড়ির অন্যপ্রান্তে পুকুরপাড়ে একটি ছোট কুঠুরি চুনকাম করে, প্রাতঃস্নানের পর কঠোপনিষদের শ্লোক বলছেন এবং ব্যাখ্যা করছেন। 

আরও পড়ুন-দ্বিতীয় বারাণসী মুর্শিদাবাদের আজিমগঞ্জে রানি ভবানীর ঐতিহাসিক বারোয়ারি পুজো

দেবেন ঠাকুর এই মূর্তি পুজো বিরোধী প্রভাব ও মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তিনি সচেতন ভাবে তা চাননি। তাই এই পুজোর কটা দিন চলে যেতেন হিমালয়ে। পাহাড়ে থাকতেন। একবার সিমলা থেকে বেড়িয়ে বাড়ি ফিরেছেন। ফিরে দেখলেন সে দিন জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জন। ব্যাস। বাড়িতে প্রবেশ না করে সোজা চলে গেলেন ব্রাহ্ম সমাজে। আর সারাদিন সেখানে গিয়ে বসে রইলেন। বাড়িতে এই সংবাদ পৌঁছনোমাত্র সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তড়িঘড়ি ঠাকুর বিসর্জন দেওয়ার ব্যবস্থা হল। আর তারপর দেবেন্দ্রনাথ বাড়ি ফিরলেন। তারপর একদিন তিনি ভাইদের অনুরোধ করলেন জগদ্ধাত্রী পুজো তুলে দিতে। আর দেখতে দেখতে উঠে গেল জগদ্ধাত্রী পুজো। তবে দুর্গাপুজো চলতে থাকল।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর একজায়গায় লিখছেন, "প্রথম বয়সে উপনয়নের পর প্রতিনিয়ত যখন গৃহেতে শালগ্রাম শিলার অর্চনা দেখিতাম, প্রতি বৎসর যখন দুর্গাপুজোর উৎসবে উৎসাহিত হইতাম তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রাম শিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।”

মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী একজায়গায় লিখছেন, "দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপুজোর সময় ইচ্ছে করেই প্রবাসে কাটাতেন।পুজোর সময় কোনও মতেই পিতা বাড়ি থাকিতেন না এজন্যই পুজোর উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না।”

দ্বারকানাথের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরেই ঠাকুরবাড়ি ধীরে ধীরে ‘ব্রাহ্ম’ হয়ে উঠল। আর খুব স্বাভাবিক পৌত্তলিকতার ঠাঁই নেই যে ধর্মে সেখানে দুর্গাপুজো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যেতে বাধ্য। যদিও হঠাৎ করে  দুর্গাপুজো বন্ধ হয়নি কারণ, পরিবারের অনেকেই তা মানতে চাননি। এদিকে দেবেন্দ্রনাথ পুজোতে কখনোই যোগ দেননি এবং কোনও দিন দেবেন না তাও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন বাড়ির বড়দের। প্রতিবছর ওই সময় তিনি হিমালয় ভ্রমণে যাওয়া শুরু করলেন।

তত্ত্বাবোধিনী সভা প্রতিষ্ঠিত হবার দশ বছর পরেও ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজো অনুষ্ঠিত হত। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ ভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের মতে, “দুর্গোৎসব আমাদের সমাজ-বন্ধন, বন্ধু-মিলন ও সকলের সঙ্গে সদ্ভাব স্থাপনের একটি উৎকৃষ্ট ও প্রশস্ত উপায়। ইহার উপরে হস্তক্ষেপ করা উচিত হয় না; করিলে সকলের মনে আঘাত লাগিবে।”

জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় তখন আদি ব্রাহ্মসমাজের ভার নিয়েছেন। আদি ব্রাহ্মসমাজের বেদীতে অব্রাহ্মণ বসা নিয়ে একটি আলোচনা সূত্রে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে জ্ঞানেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বাংলার ১৩১৮ সালের ২৯ ভাদ্র একটি চিঠিতে লিখেছেন, “যদি আদি ব্রাহ্মসমাজে ব্রাহ্মণপূজাই চালাতে চান তবে তেত্রিশ কোটি কি অপরাধ করল?"

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অনেকটাই দেবেন্দ্রনাথের আদর্শে অনুপ্রাণিত। জীবনে কোনও দুর্গোৎসবে তিনি অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু কবিতা, ছোট গল্প, নাটক বা উপন্যাসের বিষয়বস্তু হিসেবে একাধিকবার উঠে এসেছে দুর্গাপুজোর নানা বিষয়। 

আরও পড়ুন- ছেলেবেলায় পুজোর সময় খুব খারাপ অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছিলেন, আড্ডায় জানালেন শাশ্বত

একেশ্বরবাদের প্রভাব দেবেন্দ্রনাথের জীবনে যত দৃঢ় হয়েছিল, পৌত্তলিকতা থেকে তিনি ততই দূরে সরে গিয়েছিলেন। এমনই এক উপলব্ধি থেকেই তিনি পরিবারে ছোট ভাইদের নিয়ে পৌত্তলিকতাবিরোধী একটি দল গড়েছিলেন একসময়। তাঁরা পুজোর সময়ে ঠাকুরদালানে যেতেন না, আর গেলেও প্রতিমাকে প্রণাম করতেন না। পুজোর সময় দেবেন্দ্রনাথ স্বেচ্ছায় প্রবাসী হতেন। রবিঠাকুর এসবই চাক্ষুষ করেছেন।

দুর্গাপুজোর ঠিক আগের ঘটনা। রবি ঠাকুর উত্তর কলকাতায় কবি সুরেশচন্দ্র সমাজপতির বাড়ি যাচ্ছেন। দেখলেন পথের দু’ধারে  দুর্গাপ্রতিমা তৈরি হচ্ছে। এই ঘটনা প্রসঙ্গে একজায়গায় তিনি লিখছেন, “দেশের ছেলে বুড়ো সকলেই হঠাৎ দিন কতকের জন্য ছেলে-মানুষ হয়ে ওঠে, সবাই মিলে একটা বড়ো গোছের পুতুল-খেলায় মেতে ওঠে।" ইতিহাস বলছে, দ্বারকানাথের মৃত্যুর মাত্র দশ বছর পর, আনুমানিক ১৮৫৭ নাগাদ ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব বন্ধ হয়ে যায়।

তথ্যঋণ: 

১| দ্বারকানাথ ঠাকুর - কৃষ্ণ কৃপালনী ২| মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৩| পিতৃস্মৃতি - রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৪| রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ - পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় ৫| চিঠিপত্র - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৬| ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল - চিত্রা দেব  ৭| আত্মজীবনী- দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর  ৮| ছিন্ন পত্রবলী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Share this article
click me!