নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বাংলার বুকে ৩২৪ ধারা লাগু করেছে। সাংবাদিক সম্মেলন করে এমনই অভিযোগ আনলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে কমিশনকে চাঁচাছোলা ভাষায় আক্রমণ করায় তাঁকে যে শোকজ করা হতে পারে সে আশঙ্কা ব্যক্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই কমিশন শেষ দফায় পশ্চিমবঙ্গের ৯ আসনে ৩২৪ নম্বর ধারাা প্রয়োগ করেছে বলে দাবি করেছেন তিনি। একই সঙ্গে রাজীব কুমারকে দিল্লিতে পাঠানো এবং অত্রি ভট্টাচার্য-কে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া নিয়েও তীব্র ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
অমিত শাহ নিয়ে তোপ মমতার
মুখ্যমন্ত্রী বুধবার রাতে কালীঘাটে যে সাংবাদিক সম্মেলন করেন সেখানে অমিত শাহ নিয়ে কমিশনের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন অমিত শাহ-কে কেন শো-কজ করা হল না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, কলকাতার বুকে দাঙ্গা করানোর জন্য বাইরে থেকে লোক আনা হয়েছিল অমিত শাহ-র মিছিলে। এর আগে রাজ্যে বিরোধী দলগুলি একাধিক মিটিং-মিছিল ও জনসভা করেছে। কিন্তু, কোথাও সেই ধরনের ঝামেলাই হয়নি বলে জানান রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। তাহলে অমিত শাহ-র মিছিল থেকে কেন এমন ঘটনা ঘটল? কমিশন-এর এই ঘটনার তদন্ত করা প্রয়োজন ছিল বলেও মনে করেন মমতা। এমনকী, অমিত শাহ-র নেতৃত্বে এই মিছিল থেকে অশান্তি ও হিংসা ছড়িয়েছে, তারজন্য কমিশন বিজেপি-র কাছে জবাব না চাওয়ায় এতে রাজনৈতিক পক্ষাপাতিত্ব-এর গন্ধও পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কমিশন নয় মোদী-শাহর ডিরেকশন
মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের অভিযোগ ৩২৪ নম্বর ধারা প্রয়োগের যে সিদ্ধান্তের কথা কমিশন ঘোষণা করেছে তা আসলে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ-র ডিরেকশন। তাঁর মতে দোষ করল অমিত শাহ আর তাঁর জন্য বাংলার মানুষকে অপমানিত করেছে কমিশন। বাংলার মানুষ এই সিদ্ধান্তকে সহজে মেনে নেবে না বলেও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাবরি মসজিদ ভাঙচুরও এত ভয়ঙ্কর ছিল না
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন বাবরি মসজিদ ভাঙচুরও এতটা ভয়ঙ্কর ছিল না, যতটা ভয়ঙ্কর ছিল মঙ্গলবার বিদ্য়াসাগর কলেজে হামলার ঘটনা। কলকাতার বুকে তাঁর জীবীতকালেও এত বড় রাজনৈতিক দাঙ্গা দেখেননি বলেও মন্তব্য করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন এক ঘটনা যে দলটির জন্য ঘটল এবং তাঁদের যিনি নেতা ছিলেন এই মিছিলে- তাঁদেরকে ছেড়ে দিয়ে বাংলার গরিমাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে বলেই মনে করছেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। বাংলা জম্মু-কাশ্মীর, ত্রিপুরা বা পঞ্জাব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর সাফ জবাব কমিশন বাংলা অত্যন্ত একটা শান্তিপূর্ণ রাজ্য। অথচ, কমিশন এবং বিজেপি বারবার এমন একটা ভাব করছে যেন বাংলায় আইনের কোনও শাসনই নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বর্থ্য়হীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, বাংলায় ছয় দফার ভোটে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় অনেক কম অশান্তি হয়েছে। নজরে পড়ার মতো যে হিংসা হয়েছে তা কেশপুরে। আর এই কেশপুরের দায়িত্ব ছিল আধা সেনার হাতে। ভোটের দিন এই এলাকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ভার যদি রাজ্য সরকারের হাতে থাকত তাহলে হিংসার ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যেত বলেই মনে করছেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়।
অমিত শাহ-র শাসানি-তেই কি ৩২৪
এই প্রশ্নও তুলে ধরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পরিষ্কার বক্তব্য নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ যা বলছেন ঠিক তারই প্রতিফলন ঘটেছে কমিশনের বক্তব্যে। অমিত শাহ-র মিছিলের জেরে কলকাতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা কতটা বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল তা গোটা দেশ দেখেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। 'পরিস্থিতি সামলাতে এবং মানুষকে নিরাপত্তা দিতে রাজ্য সরকার যথাযথ কাজও করেছে। অথচ, অমিত শাহ এদিন সকালে নয়াদিল্লিতে বসে সাংবাদিক সম্মেলন করে রাজ্য সরকারের উপর দায় চাপালেন এবং নানা ধরনের উস্কানি মন্তব্য করলেন। এই ঘটনার পর কমিশন একতরফাভাবে যে সিদ্ধান্ত নিলেন তাতে মোদী-অমিত শাহদের হুমকির প্রতিফলন ঘটছে।'- এহেন মন্তব্যও করেন মমতা।
মমতার তোপ- 'মিস্টার কমিশন'
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিন যে ভাষায় কমিশনকে আক্রমণ করেছে তাতে তাঁর বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে বাংলা ও বাংলার মানুষের জন্য তিনি এই ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। নির্বাচন কমিশন একটা সাংবিধানিক বেঞ্চ। কিন্তু, তাঁরা কার্যত যে ভাবে মোদী-অমিত শাহদের কথা শুনে চলছে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলেও মন্তব্য করেন মমতা। কমিশনকে 'মিস্টার কমিশন' বলে মন্তব্য করে মমতা জানিয়েছন, এই অপমানের জবাব বাংলার মানুষ দেবে।
'মোদীবাবুর এমার্জেন্সি'
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, নরেন্দ্র মোদী বুধবার কলকাতার শহরতলিতে ২টো সভা করেন। আর সেই সভা থেকে 'এমার্জেন্সি'-র মতো অবস্থা রাজ্যে সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। রাজ্য যদি এমার্জেন্সি-র মতো পরিস্থিতি হতো তাহলে কি বিরোধী দলগুলি শান্তিপূর্ণভাবে কোনও মিটিং-মিছিল করতে পারত? এমন প্রশ্নও তুলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বুধবারের বদলে বৃহস্পতিবার রাত থেকে কেন ৩২৪
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরও অভিযোগ, ইচ্ছাকৃতভাবেই কমিশন বৃহস্পতিবারের দিন নির্ধারণ করেছে। কারণ বৃহস্পতিবার রাজ্যে নরেন্দ্র মোদীর আরও ২ সভা আছে। এই সভাগুলো মিটে যাওয়ার পর ৩২৪ নম্বর ধারা লাগু করছে কমিশন। অথচ, শুক্রবার তাঁর বেশকিছু কর্মসূচি ছিল। কমিশনের সিদ্ধান্তে সেগুলি এখন বৃহস্পতিবারে এগিয়ে নিয়ে আসা ছাড়া কোনও উপায় নেই বলেও মন্তব্য করেন। কমিশন যদি ৯ লোকসভা আসনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এতটাই আন্তরিক থাকবে তাহলে কেন বুধবার সন্ধ্য়ায় ঘোষণার পর থেকে ৩২৪ লাগু করা হল না? এমন প্রশ্নও তুলেছেন মমতা।
কাউকে ছেড়ে কথা বলা হবে না
নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ-দের সঙ্গে সঙ্গে কমিশনকেও এদিন নজিরবিহীন আক্রমণ করেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। তিনি সাফ জানান, 'নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ। কিন্তু, সেখানে যে ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তাতে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল-ই সমস্ত সুবিধা পাচ্ছে। সুতরাং, এটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে কারা এই কমিশনে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এনাদের দেশ ও দেশবাসীর জন্য কাজ উচিত বলেও মন্তব্য করেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। কমিশন যেমন কথায় কথায় তাঁর এবং তাঁদর দলের লোকেরদের ও রাজ্য প্রশাসনের দক্ষ কর্মীদের দোষ ধরে বেড়াচ্ছে। তেমনি কমিশনে যারা বসে আছেন তাঁদের সম্পর্কেও বিস্তারিত তথ্য আছে। এই তথ্য যথাসময়ে প্রকাশ করা হবে। সুংতরাং, কমিশনে যারা বসে আছেন তাঁরা যেমন কারোর দ্বারা নিয়োগপত্র পেয়ে থাকেন, ঠিক তেমনি জনতার রায়ে জিতে তাঁরা যখন সরকার গড়বেন তখন এসব-ই সামনে আনা হবে। যার যার বিরুদ্ধে যা যা অভিযোগ আছে তার তদন্ত করা হবে। তখন তারা কোথায় পালাবেন?' তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এমন কমিশন কস্মিনকালেও দেখেননি বলে মন্তব্য করেন মমতা।