
পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী, সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্তর পর সময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলে আরও এক নক্ষত্র পতন। প্রায় একমাসের জীবন যুদ্ধের পর অবশেষে 'জীবনের দৌড়' থামল। না ফেরার দেশে পারি দিলেন প্রাক্তন অলিম্পিয়ান ও মোহনবাগান রত্ন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। ২৪ দিন হাসপাতালে থাকার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সময় বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা ময়দান তথা ভারতীয় ফুটবলে বেশি পরিচিত বদ্রু বন্দ্যোপাধ্য়ায় নামেই। ফুটবল জীবনে অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ কলকাতা ময়দান।
বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩০ সালের ৩০ জানুয়ারি। বাড়ির সকলেই ফুটবল অনুরাগী হওয়ায় খেলাটার প্রতি ছোট বেলা থেকেই আলাদা একটা ভালোবাসা জন্মেছিল ছোট্ট সমর বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা শশাঙ্ক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় ফুটবল ভালবাসতেন। প্রতি বিকেলেই বাড়ির উঠোনে ফুটবল নিয়ে আড্ডা হত। সেখানে ছোট্ট বদ্রুর প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও খেলাটাক প্রতি আগ্রহ ও এই খেলাকেই নিজের কেরিয়ার বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই বালি হিন্দু স্পোর্টিং ক্লাবে খেলা শুরু। মাঝেমাঝে ফুটবল খেলতে যেতেন বালি ওয়েলিংটন ক্লাবে। স্কুল থেকে ফেরার পর প্রতিদিন ফুটবল খেলাটা রুটিনে পরিণত করে ফেলেছিলেন।
মিলন সমিতি ক্লাবে অভিষেক হয় বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ১৯৪৮-এ প্রথম বার পেশাদার চুক্তিতে সই বালি প্রতিভা ক্লাবে। কলকাতা ফুটবল লিগে তৃতীয় ডিভিশনে খেলতেন। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফুটবল চালাচ্ছিলেন বদ্রু। তারপর যোগ দেন বিএনআর-এ। কলকাতা লিগে বিএনআরের হয়ে বেশ ভাল খেলেন তিনি। ক্লাবকে চ্যাম্পিয়ন করেন তিনি। সেখান থেকেই তাকে দলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মোহনবাগান। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত সাত বছর মোহনবাগান ক্লাবের হয়ে খেলেছিলেন বদ্রু। ১৯৫৮ সালে অধিনায়কও ছিলেন। সবুজ মেরুন জার্সিতে ১০টি ট্রফি জিতেছেন। ডুরান্ড কাপ, কলকাতা লিগ, আইএফএ শিল্ড, রোভার্স কাপ সেই সময়কার কোনও ট্রফিই বাদ নেই বদ্রুর ক্যাবিনেটে। মোহনবাগান দলের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া, হংকং এবং সিঙ্গাপুরে বিদেশ সফরেও গিয়েছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৯ সালে মোহনবাগান রত্ন দেওয়া হয় তাকে।
ভারতীয় দলের জার্সি গায়েও অসংখ্য কৃতিত্ব রয়েছে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। জাতীয় দলের নেতৃত্বও দিয়েছেন তিনি। ১৯৫৬ সালে মেলবোর্ন অলিম্পিক্সে এই তারকা ফরোয়ার্ডের নেতৃত্বেই ভারত সেমিফাইনালে উঠেছিল। তবে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে হেরে থেমেছিল ভারতের স্বপ্নের দৌড়। প্লেয়ার এবং কোচ হিসেবে সন্তোষ ট্রফি জিতেছেন বাংলার হয়ে। ১৯৫৯ সালে বার্মা শেল কোম্পানিতে চাকরি পান। শিলিগুড়িতে পোস্টিং ছিল। তবু খেলার প্রতি ভালবাসা এতটাই ছিল যে কলকাতায় ট্রেনে করে এসে সপ্তাহান্তে অনুশীলন করতেন। কিন্তু বেশি দিন সে ভাবে চালাতে পারেননি। সে বছরই বুটজোড়া তুলে রাখেন। ফুটবল থেকে অবসরের পর বড়িশা স্পোর্টিং ক্লাব এবং বাংলা দলকে কোচিং করানো শুরু করেন। ১৯৬১ সালে বাংলা সন্তোষ জেতে তাঁরই কোচিংয়ে। ভারতীয় ফুটবল দলের নির্বাচকও ছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে রাজ্য সরকারের তরফে তাঁকে জীবনকৃতি পুরষ্কার দেওয়া হয়। মোহনবাগানের তরফে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে বানানো হয়েছে পোস্টাল স্ট্যাম্পও।
গত ২৭ জুলাই গুরুতর অসুস্থ হয়েই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বদ্রু বন্দ্যোপাধ্যায়। দিনে দিনে তাঁর শারীরিক অবস্থান অবনতিই হচ্ছিল। অ্যালজাইমারস, উচ্চ রক্তচাপ এবং অ্যাজোটেমিয়া- বিভিন্ন সমস্যা ছিল তাঁর। করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন বলেও জানা গিয়েছে। ক্লাবের প্রাক্তন প্লেয়ারের শারীরিক অবস্থার খবর পেয়ে ক্রীড়া মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর চিকিৎসার জন্য গঠিত হয়েছিল মেডিক্যাল বোর্ডও। কিন্তু ২৪ দিন লড়াই করার পর অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই প্রাক্তন ফুটবলার। বাংলা তথা ভারতীয় ফুটবলে বদ্রু বন্দ্যোপাধ্য়ায়ের অবদান অনস্বীকার্য।