তিন কন্যা থেকে চোখের বালি, সত্যজিৎ রায় থেকে ঋতুপর্ণ ঘোষ, টলিউডের রসদ যখন রবীন্দ্রনাথ
২২ শ্রাবণ, গোটা শহরতলী এদিন যেন প্রতিবছরই ডুকরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। কবিগুরুর প্রায়ণে এদিন ভিজে যায় শহরের পথঘাট, তিনি বিশ্বকবি, তাঁর কলমের ধারে শত শতবর্ষের ভাবাবেগ জড়িয়ে রয়েছে পরতে-পরতে। তালিকা থেকে বাদ পড়েনি চলচ্চিত্র জগতও। বাংলা সংস্কৃতিক জগতের এক অধ্যায় কবিগুরু। পদ্য থেকে গদ্য, নৃত্যনাট্য, গান তাঁর অবদানে পুষ্ট আপামর বাঙালী। তারই কলম সৃষ্ট চরিত্রেরা ভিন্ন সময় জীবন্ত হয়ে উঠেছে ক্যামেরার সামনে, তুলেধরেছে তৎকালীন সমাজ জীবনের একটুকরো উপমা। বিভিন্ন পরিচালকের হাতে তাদের মুক্তি ঘটেছে প্রেক্ষাগৃহে। সাদা কালো থেকে রঙিন পর্দা, পরিবর্তন এসেছে সমাজের, দৃষ্টিভঙ্গির, কিন্তু আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা। তিনিই রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কলম অনায়াসে মানুষের মনের গভীরের আবেগকে ছুঁয়ে ফেলত চোখের পলকে।
চোখের বালি (২০০৩)- ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত এই ছবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে তৈরি। সম্পর্কের টানাপোড়েনের যে সমীকরণ তাঁর কলমে সেই সময় উঠে এসেছিল, তা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও সমাজের কাছে সমান তৎপর্য বহন করে। অভিনয়ে ছিলেন ঐশ্বর্য রাই, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, টোটা রায়চৌধুরী।
চারুলতা (১৯৬৪)- সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই ছবির গল্প নেওয়া হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত নষ্টনীড় উপন্যাস থেকে। যেখানে মেয়েদের চৌহদ্দির মধ্যে থেকেও কতটা সাহসীকতা ও বুদ্ধির জোড়ে নিজের জায়গা করে নিতে হয় তা তিনি দেখিয়েছিলেন। মাধবী মুখোপাধ্যায় ছবির মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
কাবুলিওয়ালা (১৯৫৭)- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কাবুলিওয়ালা ছোট গল্প থেকে নেওয়া এই ছবির কাহিনী। মানুষের প্রতি বিশ্বাস, সারল্যতা ও আবেগ কতটা তাৎপর্য বহন করে তা এই ছবির প্রতিটি ভাষায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর গল্পে তার কলম অনায়াসে বলে যায় এক নিপাট স্নেহের ইতিকথা। অভিনেত্রী দেবশ্রী রায় এই ছবিতে শিশু শিল্পী হিসেবে কাজ করেছিল।
অতিথী (১৯৬৬)- পরিচালক তপন সিনহা এই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প অবলম্বনে এটি তৈরি করেছিলেন। যেখানে তারা নামে একটি ছেলে, যে তার বাড়ির প্রতি স্বভাবতই দুর্বল তারই নানান খুঁটিনাটি ছোট আবেগগুলো নিয়ে মজার ছলে তৈরি এই গল্পের পটভূমি।
ঘরে বাইরে (১৯৮৪)- পরিচালক সত্যজিৎ রায় রাজনৈতিক পটভূমিতে এই ছবিকে সাজালেও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলম থেকে জাত এই গল্পের পটভূমি ছিল যথেষ্ট বাস্তববাদী। তিনটি চরিত্রের ত্রিকোণ প্রেমের গল্পে গাঁথা এই ছবির ভীত, বিমলা, সন্দীপ ও নিখিলেশ। অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভিক্টর বন্দোপাধ্যায়।
চতুরঙ্গ (২০০৮)- সুমন মুখোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবির প্রেক্ষাপটেও রবীন্দ্রনাথের অবদান। তারই গল্প অনুসারে তৈরি এই ছবি। যেখানে বাংলা এক বিশেষ সামাজিক স্তরের বিবরণে ফুঁটে উঠেছে গল্পের মাধুর্যতা। ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ও জয় সেনগুপ্ত।
এলার চার অধ্যায় (২০১২)- পরিচালক বাপ্পাদিত্য বন্দোপাধ্যায় পরিচালিত এই ছবির মূল প্রেক্ষাপট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত চার অধ্যায়। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে তৈরি এই ছবির গল্প। বিভিন্ন ধাপে পরিণতি পাওয়া এই গল্প রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ১৯৩৪ সালে। মুখ্যভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন পাওলি দাম।
নৌকাডুবি (২০১১)- ঋতুপর্ণ ঘোষ পরিচালিত ছবি নৌকাডুবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। ঝড়ের ফলে বিয়ের রাতে বদলে যাওয়া চারটি জীবনের সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প। ছবিতে অভিনয় করেছিল প্রজেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, রাইমা সেই, রিয়া সেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানেই বরাবরের এক ভিন্ন স্বাদের অনুভুতি, যাঁর লেখনির ছোঁয়ায় এক এক চরিত্রেরা হয়ে উঠেছে জীবন্ত। টলিউডের তাঁদের দাপট নেহাতই কম নয়।
কেবল সাহিত্যের ছোঁয়া, এমনটা নয়, বরং সমাজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলা সাধারণ মানুষের না বলা কথারাই কত সহজে জায়গা করে নিয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কলমে। যা আজ হতে শতবর্ষ পড়েও একইভাবে থাকবে তরতাজা।