Published : Mar 28, 2020, 05:21 PM ISTUpdated : May 24, 2020, 09:01 PM IST
গোটা বিশ্ব এখন করোনাভাইরাস-এর ভয়ে কাঁপছে। এ এক অদ্ভূত যুদ্ধ। শত্রু চোখের সামনেই রয়েছে, অথচ তাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না। আর সেটাই করোনাভাইরাস-কে আরও ভয়ানক করে তুলেছে। কিন্তু, ভাইরাস নিয়ে এত ভয় পাওয়ার কি সত্যিই কারণ আছে? কিছু কিছু মানুষ-ও তো এমন আছে, যারা ভাইরাসের থেকেও ভয়ঙ্কর। ভাইরাসের মতোই চোখের সামনে থেকেও অদৃশ্য আঘাত হানে। এরকমই একজন মানুষ (কিংবা অমানুষ), দেবিন্দর শর্মা ওরফে 'ডক্টর ডেথ'।
দারুণ সমস্যায় পড়েছিল গুরগাঁও-এর পুলিশ। ২০০২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, গুড়গাঁও, দিল্লি এবং জয়পুর থেকে পর পর প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন ট্যাক্সি ড্রাইভার রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন। ওই রুটগুলির ট্যাক্সি ড্রাইাভারদের মধ্যে একরকম আতঙ্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ঘটনাগুলির মধ্যে যে যোগসূত্র আছে তা বেশ বুঝতে পারছিল পুলিশ। কিন্তু, তারপরেও অঙ্কটা কিছুতেই মেলাতে পারছিল না, কারণ একজনও নিখোঁজ ড্রাইভারের মৃতদেহ বা তাদের একটিও ট্যাক্সি তারা উদ্ধার করতে পারছিল না।
29
সূত্র আসে নরেশ নামে এক গুড়গাঁও-এর এক ট্যাক্সি ড্রাইভার একইভাবে নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার থেকে। ২০০২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি গুড়গাঁও থেকে বরেলি-তে একটি ভাড়া নিয়ে যেতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাঁর ভাই পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন। সৌভাগ্যবশত নরেশ গুড়গাঁও বাস টার্মিনাস থেকে ভাড়া তোলার সময় তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর ভাইপো সঞ্জু। তার বর্ণনা থেকেই পুলিশ সন্দেহভাজনের একটি স্কেচ তৈরি করতে পেরেছিল। সেটাই ছিল তদন্তের একমাত্র সূত্র। এরপর ট্য়াক্সি স্ট্য়ান্ডে স্ট্যান্ডে ওই স্কেচ হাতে অপেক্ষা করা শুরু করেছিল সাদা পোশাকের পুলিশ। সেই সময়ই আরও এক ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন দেবিন্দর শর্মা ওরফে ডক্টর ডেথ।
39
পুলিশ ১০০ শতাংশ নিশ্চিত ছিল ২০ থেকে ২৫ জন ট্যাক্সি ড্রাইভারের নিখোঁজ হওয়ার পিছনে এই লোকটিরই হাত রয়েছে। কিন্তু তাকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করার মতো কোনও প্রমাণই ছিল না পুলিশের কাছে। কিন্তু, পুলিশকে অবাক করে দিয়ে দেবিন্দর শর্মা সহজেই নিজের অপরাধ কবুল করেন। যা শুনে চমকে গিয়েছিল পুলিশ। তখনও অবধি তাদের ধারণা ছিল, ডক্টর ডেথ-এর শিকারের সংখ্যা ২০-২৫ হবে। কিন্তু, সে নিজে মুখে জানায় সংখ্যাটা ১০০ ছোয়ার পর সে গোনা ছেড়ে দিয়েছিল।
49
এরপর সে পুলিশকে এক এক করে তার অপরাধের কাহিনি শোনাতে থাকে। দেবিন্দর শর্মা জানায়, তার আরও অন্তত দুইজন সহকারি আছে। দিল্লি, গুড়গাঁও বা জয়পুরে সে মাঝে মাঝেই যেত, তারপর সেখান থেকে আলিগড়ে ফেরার ট্যাক্সি বুক করত। অনেকসময় তাড়া আছে বলে তাদের বেশি ভাড়া দেওয়ার প্রলোভনও দেখাত। তারপর সারা রাস্তা ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করতে করতে এমনকী খাবার ভাগ করে খেতে খেতে আসত। গাড়ি থেকেই আলিগড়ের বাইরে এক জায়গায় তার সঙ্গীদের দাঁড়াতে নির্দেশ দিত। তারপর শহরের এক নির্জন জায়গা নিয়ে গিয়ে হয় পিটিয়ে মেরে ফেলত নাহলে গলায় তার বা দড়ি পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে মারত।
59
এরপর-ও পুলিশ-কে যে প্রশ্নটা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল, তা হল, এতগুলি হত্য়া সে করে থাকলে, সেইসব লাশ কোথায়? গাড়িগুলিই বা কোথায়? ডক্টর ডেথ লাশ গায়েব করার এক দারুণ পন্থা নিয়েছিল। যে কারণে আজ অবধি পুলিশ একটিও লাশ পায়নি। সে সুযোগ বুঝে আলিগড় শহরের কসমপুর খাল ও হাজারা খালে লাশগুলি ফেলে দিত। ওই খালগুলিতে প্রচুর কুমির রয়েছে। তাই লাশ ফেলার সঙ্গে সঙ্গে কুমিরের দল সেগুলো খেয়ে সাফ করে দিত। আর গাড়িগুলি সে বিক্রি করে দিত এক গাড়ি চুরির গ্যাঙ-এর কাছে। বদলে ৫০ হাজার টাকা করে পেত। আর ড্রাইভারের কাছে যে টাকাকড়ি থাকত তাও তার পকেটে যেত। তার সহকারিরাও ওই গাড়িচুরির দলেরই লোক, তারা কিন্তু এখনও অধরা।
69
অদ্ভূত বিষয় হল বাইরে থেকে এই ভয়ানক সিরিয়াল কিলারকে চেনার কোনও উপায় নেই। বস্তুত তিনি একজন আয়ুর্বেদিক ডাক্তার। নিজের চেম্বার খুলে প্রতিদিন রোগী দেখতেন। পসারও ছিল। বস্তুত, এলাকায় আয়ুর্বেদ ডাক্তার হিসাবে তার বেশ নামযশই ছিল। তার পিছনে যে এরকম একজন মারাত্মক খুনি লুকিয়ে আছে তা প্রথমটায় কেউ বিশ্বাসই করে উঠতে পারেননি।
79
দেবিন্দরের সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তির পরও পুলিশের পক্ষে তাঁকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করাটা সহজ হয়নি, লাশ বা চোরাই গাড়ি - কোনওটাই মেলেনি বলে। তবে পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে মোট ২১টি হত্য়ার দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা সাজিয়েছে পুলিশ। এরমধ্যে বেশ কয়েকটিতে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। ২০০৮ সালে একটি মামলায় তাকে মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে। বাকি মামলার শুনানির কাজ এখনও চলছে।
89
কিন্তু, কেন বেছে বেছে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের হত্য়া করত ডক্টর ডেথ? এর কোনও সদুত্তর আজও মেলেনি। জানা যায়নি ২০০২ সালেই বা কী ঘটেছিল যার জন্য এই শান্তশিষ্ট ডাক্তার দুর্ধর্ষ হত্যাকারী হয়ে উঠেছিলেন। তবে মনোবিশেষজ্ঞরা মনে করে ডাক্তারবাবুাসলে নিজেই স্প্লিট পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। অর্থাৎ, দ্বৈত চরিত্রের সমস্যা। একজন আয়ুর্বেদ ডাক্তার, আরেকজন খুনি। আগে থেকেই এই সমস্যা শুরু হলেও ২০০২ সালে এমন কিছু ঘটেছিল যাতে তার ভারসাম্যটা পুরোপুরি ন্ষ্ট হয়ে যায় বলে মনে করেন তাঁরা।
99
আপাতত তাকে গুরগাঁওয়ের ভোন্দসি কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হল, কখনও তারমধ্য়ে কোনও উদ্বেগ দেখা য়ায়নি। ফাঁসির সাাজার পর বলেছিল, নিরপেক্ষ রায় হয়নি। সে কোনও অপরাধ করেনি। একটা শক্তি তার বিরুদ্ধে কাজ করছে এবং এটা তাদের কাজ। ফাঁসিকাঠে উঠেই তিনি সব বলবেন। তার কাছে কারারক্ষী রা তো বটেই এমনকী অন্যান্য সহবন্দি যারা নিজেরাও কুখ্যাত অপরাধী, দেবিন্দর শর্মার কাছে ঘেসতে ভয় পায়। ডক্টর ডেথ নাকি মাঝে মাঝেই মুচকি হেসে বলে ওঠে, 'অনেকদিন কাউকে হত্য়া করা হয় না, ১০ সেকেন্ড লাগে'।