মৃত্যু এমনিতেই রহস্যময়। মৃত্যুর পর কী হয় - সেই রহস্যের সমাধানে এখনও একাধিক গবেষণা চলছে। কিন্তু তারওপর গোটা বিশ্ব জুড়ে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে যার কারণ খুঁজতে গিয়ে রীতিমত নাজেহাল হয়েগেছে তদন্তকারীরা। তৎকালীন তদন্তকারীরা হার মানলেও পরবর্তীকালে সেই নিয়ে বিস্তর চর্চা করেও কোনও দিশা দেখতে পারননি ইতিহাসবীদ ও গবেষকরা। সেই রকম বিশ্বের ১০টি রহস্যে মোড়া মৃত্যুর (Mysterious Deaths)ঘটনা এখানে রয়েছে যেগুলি এখনও পর্যন্ত সমধান করতে পারেননি কেই।
এভারেস্ট ম্যালরি ও আরভিন (Mallory And Irvine On Everest)
১৯২৪ সালের ব্রিটিশ দলের অসমাপ্ত এভারেস্ট অভিযান। ১৯২৪ সালের ৪ জুন ব্রিটিশ পর্বতারোহী জর্জ ম্যালোরি ও অ্যান্ডু আরভিন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য অভিযান শুরু করেছিলেন। এটাই ছিল তাঁদের প্রথম এভারেস্ট যাত্রা। সেই দলের একই সদস্য জানিয়েছিলেন অভিযান শুরুর চার দিন পরে দুই অভিযাত্রীকে চূড়া থেকে তাঁরা মাত্র ২৪৫ মিটার নিচে দেখা দিয়েছিল। তখনই গোটা এলাকা মেঘে ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু তারপরই রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যান জর্জ ম্যালোরি ও অ্যান্ডু আরভিন। তন্ন তন্ন করে খোঁজার পরেও তাদের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি। উদ্ধার হয়নি মৃতদেহ। তবে ১৯৯৯ সালে একটি অভিযানের সময় তাদের ব্যবহার করা একটু কুড়ুল উদ্ধার হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন কিনা তা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক।
ওয়ালেস কেস (Wallace Case)
১৯৩১ সালে ব্রিটেনের লিভারপুলের বাড়িতে মৃত্যু হয়েছিল গৃহবধূ জুলিয়া ওয়ালেসের। এই হত্যাকাণ্ডের রহস্যের পর্দা আজও উন্মোচন করতে পারেননি অনুসন্ধানী। তবে এই হত্যাকাণ্ড তদন্তকারীদের পাশাপাশি গবেষকদের আজও নাড়িয়ে দেয়। এয়েলেসের স্বামী উইলিয়ম একজন বিমা কর্মী ছিলেন। হঠাৎ একটি চিঠি মেয়ে তিনি সেই মেনল্যান্ড গার্ডেনস ইস্টে-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু কেরেছিলেন। কিন্তু জানতে পারেন এমন কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু সেই দিনই বাড়ি ফিরে দেখেন স্ত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রথমে স্বামীকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উচ্চ আদালতে তিনি মৃত্যুদণ্ড এড়াতে সক্ষম হন। অনুসন্ধানীদের মনে বিমাকর্মী সহকর্মীকে দিয়ে স্ত্রীকে খুন করেছিলেন।
ফ্লাইট ১৯ এর অন্তর্ধান (Flifgt 19)
ফ্লাইট ১৯ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর গ্রুম্যান টিবিএফ অঅযাভেজ্ঞার যুদ্ধবিমান। এটি ১৯৪৫ এর ডিসেম্বরে ফ্লোরিডার উপকূলে প্রশিক্ষণের সময় নিখোঁজ হয়ে যায়। পাঁচটি অ্যাভেঞ্জার বিমানে ১৪ জন বিমানকর্মী ছিলেন। বিমানগুলির খোঁজে ফ্লাইং বোটে পাঠান হয়েছিল। সেটিও নিখোঁজ হয়ে যায়। এই ঘটনার পরথেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের জন্ম। এখনও পর্যন্ত এই রহস্যের সমাধান কেউ করতে পারেনি। কারণ বিমানগুলি ফ্লোরিডা-পুয়ের্তোরিকা-বারমুডার মধ্যে হারিয়ে যায়। অনেকের দাবি বিমানগুলি ভিনগ্রহীরা চুরি করে নিয়ে গেছে। এই ঘটনা নিয়ে স্টিফেন স্পিলবার্গও সিনেমা তৈরি করেছে।
ডিবি কুপার এর অন্তর্ধান (Disappearance Of DB Cooper)
ডিবি কুপার হল এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির ছদ্মনাম। যে ব্যক্তি ১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর বিকেলে পোর্টল্যান্ড থেকে সিয়াটল যাওয়ার জন্য বোয়িং ৭২৭ হাইজ্যাক করেছিলেন। সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি ড্যানকুপার নামে একটি টিকিট কিনে বিমানে চড়েছিল। বিমান অবতরণের সঙ্গে সঙ্গেই বোমা দিয়ে বিমান উড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে ২ লক্ষ মার্কিন ডলার মুক্তিপণ একটি প্যারাস্যুটও আদায় করেছিল। তারপর বিমান যখন ৩ হাজার মিটার উচ্চতায় ছিল তখন বিমানের পিছনের দরজা দিয়ে প্যারাশ্যুটে বেরিয়ে যায়। প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর চিরতরে হাতিয়ে যায় সেই অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি। তারপর এফবিআই ব্যপক তল্লাশি শুরু করেছিল। কিন্তু হ্যাইজ্যাকারকে চিহ্নিত করা যায়নি। উদ্ধারও হয়নি কোনও চিহ্ন। ডিবি কপারের প্রকৃত পরিচয় আজও রহস্যে মোড়া।
গ্যালাপাগোসের ব্যারনেস (Baroness on Galapagos)
অস্ট্রিয়ান মহিলা। যিনি আচমকাই ১৯৩৫ সালে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের প্রত্যন্ত ফ্লোরিয়ানা থেকে নিঁখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালের জার্মান দম্পতি ফ্রেডরিখ রিটার ও ডোরে স্ট্রেচ ইউটোপিয়ান জীবনধারায় বিশ্বাস করতেন। যা জার্মান সমাজে তাদের জনপ্রিয় করেছিল। ১৯৩৩ সালে ব্যারনেস তার দুই তরুণ জার্মান প্রেমিক রবার্ট ফিলিপনস ও রুডলফ লরেঞ্জের সঙ্গে এসেছিলেন। দ্বীপে বাড়ি তৈরি করেন। ১৯৩৪ সালের ২৭ মার্চ ব্যারনেস তার প্রেমিক ফিলিপনস নিখোঁজ হয়ে যান। কয়েক দিন ব্যারনেসের অন্য প্রেমিক রুডলফ দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেন। তিনি নরওয়ের এর মৎসজীবীর সঙ্গে যাত্রা শুরু করেন। কয়েক মাস পরে তাদের মমি করা দেহ উদ্ধার হয়েছিল একটি জলবিহীন দ্বীপে। উদ্দার হয়েছিল নৌকাটি। কিন্তু কেন এই ঘটনা তা এখনও স্পষ্ট নয় গবেষকদের কাছে
অ্যামেলিয়ার ইয়ারহার্টের শেষ বিমান (Amelia Earhart)
মার্কিন বৈমানিক অ্যামেরিয়া ইয়ারহার্ট ছিলেন বিশ্বের প্রথম মহিলা বিমান চালক। ১৯৩২ সালের মে মাসে আটলান্টিকে একা একা ননস্টপ বিমান চালিয়ে একটি রেকর্ডও করেছিলেন। ১৯৩৫ সালে হনলুলু থেকে ক্যালিফোর্নিয়া- একাই বিমান চালিয়েছিলেন। তবে রহস্যজনকভাবে ১৯৩৭ সালে ইয়ারহার্ট থেকে ন্যাভিগেটর ফ্রেট নুনান যাওয়ার যসময় অ্যামেলিয়ার বিমানটি প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর হারিয়ে যায়। দীর্ঘ দিন ধরে তল্লাশি চালিয়েও কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি বিমানটির। তবে এখনও অনেক রহস্য অনুসন্ধানী বেসরকারিভাবে বিমানটির খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে।
দিয়াতভ পাসের ঘটনা (Dyatov Pass)
১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় উরাল পর্বতমালায় অনুসন্ধানকারীরা বেশ কয়েকটি তল্লাশি চালিয়ে ৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল। মৃতরা একটি স্কি ট্র্যাকিং দলের সদস্য। উদ্ধার হয়েছিল তাবুও। কিন্তু তার ভিতরে কিছু সরঞ্জাম ছিল। যে ৯ জনের দেহ উদ্ধার হয়েছিল তাদের দুজনের মাথার খুলি ভাঙা , একজনের জিহ্বা ছিল না। দুজনের পাঁজর ভাঙা ছিল। কী কারণে এই নৃশংস মৃত্যু তা আজও স্পষ্ট নয়। তৎকালীন সোভিয়েত সরকার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে মৃত্যু বলে দাবি করেছিল। কিন্তু অনেকে সেইদাবি উড়িয়ে দিয়ে অতিবড় প্রানীর হামলা তত্ত্ব খাড়া করেন। কিন্তু কোন প্রাণী হামলা চালিয়েছিল তা এখনও স্পষ্ট নয়।
তামান শুদের মামলা (Taman Shud)
১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে অ্যাডিলেড শহরের দক্ষিণে একটি সমদ্র সৈকতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল এক ব্যক্তির দেহ । তার পকেট থেকে উদ্ধার হয়েছিল একটি চিরকুট। ফরাসি ভাষায় লেখা সেই চিরুকূটই অস্ট্রেলিয়ার সবথেকে রহস্যময় মৃত্যু বলে দাবি করেন তদন্তকারীরা। মৃতদেহের কোনও পরিচয় পাওয়া যায়নি। শুধু উদ্ধার হয়েছিল একটি ট্রেনের টিকিট, চিরুনি আর কিছু সিগারেট। আর কয়েকটি কাগজের চুকরো। যার ওপর মুদ্রিত ছিল তামান শুদ। কী এই তামান শুদ -- এই শব্দের ফরাসী অর্থ শেষ। ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত বইয়ের শেষে লেখা ছিল তামান শুদ। মৃত ব্যক্তিকে বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে দাবি করেছিলেন প্যাথলজিস্ট। তদন্তে নেমে পুলিশ কবিতার বইয়ের একটু অনুলিপিও খুজে পেয়েছিল। যেখানে তামান শুদ লেখা শব্দগুলি ছিঁড়ে দেওয়া হয়েছিল। বইটিতে একটি ফোননম্বরই ছিল। যেটি অস্ট্রেলিয়ার এক মহিলার। কিন্তু মহিলা মৃত ব্যক্তিকে চিন্তেন না। বইটির মালিক অন্য ব্যক্তি। তিনি পড়ার জন্য বইটি ধারদিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বইটি থেকে একদল বিশেষজ্ঞ দাবি করেছিলেন মৃত ব্যক্তি গুপ্তচর ছিলেন। বইয়ের মাধ্যমে ম্যানুয়ার এনক্রিপশন বা ওয়ান টাইম প্যাড ব্যবহার করে কোনও তথ্য সরবরাহ করছিলেন। তবে নিহত ব্যক্তির পরিচয় এখনও অধরা।
মেরি সেলেস্ট (Mary Celeste)
মেরি সেলেন্ট, পূর্বে আমাজন নামে পরিচিত। আমেরিকার বাণিজ্যিক জাহাজ। ১৮৭২ সালে এটি পূর্ব আটলান্টিকের পর্তুগালের অ্যাজোরস দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ৬৪০ কিলোমিটার পূর্বে শেষবারের মত সমুদ্রে ভেসে যেতে দেখা গিয়েছিল। এই জাহাজের সঙ্গে একটি কানাডিয়ার জাহাজ বাঁধা ছিল। কিন্তু অদ্ভুদভাবে জাহাজের ৭ জন ক্রুজ মেম্বারসহ ১০ জন যাত্রীর কোনও সন্ধান আজও পাওয়া যায় না। জাহাজের একটি লাইফবোটই নিখোঁজ। এই জাহাজ নিয়ে আর্থার কেনান ডয়েল যেমন গল্প লিখেছেন তেমনই তৈরি হয়েছে একাধিক তথ্যচিত্র। দেড়শো বছর পুরনো এই ঘটনা এখনও নাড়া দেয় বহু মানুষকে।
দক্ষিণ মেরুতে বিষক্রিয়া (South Pole Poisoning)
২০০০ সালের ১২ মে অন্ধকার অ্যান্টার্কটিক শীতের মাঝামাঝি সময় রডিন মার্কস নামে এক অস্ট্রেলিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমুন্ডসেন-স্কট স্টেশনে আকস্মিক অসুস্থ হয়ে যান।তারপর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর দেহ বসন্ত পর্যন্ত হিমায়িত করা ছিল। দক্ষিণ মেরুতে। তারপর তাঁর দেহ নিউজিল্যান্ডে এনে ময়নাতদন্ত করা হয়। তখন জানান হয় মিথানল বিষক্রিয়ায় তিনি মারা গেছেন। সম্ভবত না জেনে মিথানল খেয়ে ফেলার কারণেই এই মৃত্যু। তারপর নিউজিল্যান্ড পুলিশ গোটা ঘটনার তদন্ত করে।কিন্তু কারণ জানা যায়নি। তবে নিউজিল্যান্ড পুলিশ আত্মহত্যার তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়েছিল। এটি ছিল দক্ষিণ মেরুর প্রথম হত্যাকাণ্ড।