'হয় ইসলাম গ্রহণ কর নতুবা মৃত্যু নাও', কাশ্মীর পণ্ডিতদের এক ছোট্ট কাহিনি

  • কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর হওয়া অত্যাচারের কাহিনি সর্বজন বিদিত
  • রাতারাতি হাজারে হাজারে কাশ্মীর পণ্ডিতদের ঘর ছাড়তে হয়েছিল
  • কাশ্মীরের বুকে বসবাসের অধিকার হারাতে হয়েছিল 
  • নতুবা জঙ্গিদের গুলির নিশানা হতে হয়েছিল তাঁদের 

Sabuj Calcutta | Published : Jan 20, 2020 3:03 PM IST / Updated: Jan 20 2020, 08:34 PM IST

"১৯৯০ সালের ২০ জানুয়ারি  কাশ্মীরি পণ্ডিতদের তিনটে পছন্দ দেওয়া হয়,  রালিভ, গালিভ ও সালিভ। অর্থাৎ  হয় ইসলাম স্বীকার করো, নয়তো মরো, নতুবা কাশ্মীর ত্য়াগ করো...। আজকের দিনটিই সেই কালোদিন যেদিন ৪ লাখ কাশ্মীরি পণ্ডিত উপত্য়কা ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য় হন।"
১৯ জানুয়ারি বেশকয়েকজন বন্ধুর প্রোফাইলে দেখলাম এই পোস্ট।  এমনিতে কাশ্মীরে যখনই রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণ নেমে আসে তখনই তুলে আনা হয় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের এই পালিয়ে  আসার বিষয়টি, গণহত্য়ার বিষয়টি। আর এখন, ৩৭০ ধারা রদ করে দিয়ে ইন্টারনেট-টেট সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ার বাজারে, এই পণ্ডিতদের ইস্য়ুটি যে সোশাল মিডিয়ায় বেশি করে ঘুরে-ফিরে আসবে, তা বলাই বাহুল্য। এই তো দেখলাম, বিধু বিনোদ চোপড়া নাকি একটি সিনেমা বানিয়েছেন, নাম 'শিকারা'। সেখানে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের অকথিত কাহিনি  নাকি তুলে ধরেছেন  তিনি।
 ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসা  সততই দুঃখের। তবু কিছু প্রশ্ন ওঠে। যা এই সময়ে দাঁড়িয়ে অত্য়ন্ত জরুরি।
নেটে গিয়ে আলজাজিরার সাইটে একটি  লেখা চোখে পড়ল। সেখানে দেখলাম জনৈক কাশ্মীরি পণ্ডিত সঞ্জয় টিক্কু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। সঞ্জয় মনে করেছেন সেদিনের কথা। তিরিশবছর আগের কথা। তাঁদের বাড়ির দেওয়ালে সেদিন একটি পোস্টার সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উর্দু ভাষায় লেখা ছিল বলে ছোট্ট সঞ্জয় নিজে তা পড়তে পারেননি। তাঁর দাদুর কাছে তা খুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। দাদু তা পড়েই কেঁদে ফেলেছিলেন। ওই পোস্টারে নাকি সঞ্জয়দের পরিবারকে কাশ্মীর ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু যে লাখখানেক কাশ্মীরি পণ্ডিত  উপত্য়কা ছেড়ে চলে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্য়ে সঞ্জয়ের পরিবারের কেউ ছিলেন না।
কুড়ির কোঠায় তখন বয়স সঞ্জয়ের। ওই হুমকি-পোস্টারটি নিয়ে তিনি সটান  একটি খবরের কাগজের অফিসে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপনের পাতায় ছাপার জন্য় টাকাও দিয়েছিলেন। আর কাগজটি তা ছেপেও দিয়েছিল হুবহু।
বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হওয়ার পর, মুসলিম প্রতিবেশীরা হইচই করে সঞ্জয়দের বাড়িতে চলে এলেন। তারপর?  ক্ষমা চেয়ে বললেন, যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে তার জন্য় তাঁরা ক্ষমাপ্রার্থী। সেইসঙ্গে সমবেত অনুরোধ-- তাঁরা যেন বাড়ি ছেড়ে চলে না যান ভুলেও।
সঞ্জয়ের সাক্ষাৎকারটি বেশ কয়েকবছর আগেকার।  পঞ্চাশের কোঠায় পড়া সঞ্জয় একটি সংগঠন চালান, কেপিএসএস। সঞ্জয়দের মতো সেখানে সেদিন যাঁরা রয়ে গিয়েছিলেন, সেই কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বিভিন্ন সমস্য়া নিয়ে কাজ করে সেই সংগঠন। সঞ্জয়ের কথায়, "এতগুলো বছরে ৬৫০ জন পণ্ডিত নিহত হয়েছেন। যদিও একজনের মৃত্যুও সমর্থনযোগ্য় নয়, কিন্তু যেভাবে দাবি করা হয় যে, ৩ থেকে ৪ হাজার পণ্ডিত নিহত হয়েছেন, তা আমরা মোটেও সমর্থন করি না।"
গণহত্য়ার তত্ত্বকে সমর্থন করেন না ইতিহাসের শিক্ষক ও গবেষক সিদ্ধার্থ গুহরায়ও। তাঁর কথায়, "একটি মৃ্ত্য়ুও আমার কাছে কাম্য় নয়। কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও বলতে হয়, যেভাবে গণহত্য়া বলে চালানো হচ্ছে বিষয়টিকে ব্য়াপারটা  কিন্তু আদতে নয়। ১৯৮৯ সালে কাশ্মীরে আন্দোলন শুরু হয়েছে। ১৯৯০ তে অনেক পণ্ডিত বেরিয়ে এসেছেন। আমি একে সমর্থন করি না। কিন্তু গোটাটাতো একটা প্রেক্ষাপটে দেখতে হবে। কাশ্মীরে কিন্তু এই হিন্দু পণ্ডিত যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কিন্তু সব দিক থেকে এগিয়ে থাকা শ্রেণি।  অন্য়দিকে মুসলিমদের অবস্থা ছিল অত্য়ন্ত কষ্টের। জমিজমা সব হিন্দু পণ্ডিতদেরই ছিল। ওঁদের ফলের বাগানে মজুর হিসেবে খাটতেন গরিব মুসলমানরা। অন্য়দিকে পণ্ডিতরা ভীষণভাবেই সরকারপন্থী, উগ্র দক্ষিণপন্থী। এটা একটা শ্রেণিগত বিরোধ ছিল। একে অহেতুক সাম্প্রদায়িক রং দেওয়া হয়।"
কথা আরও রয়েছে। কাশ্মীরিরা মনে করতেন, তাঁদের দুঃখ দুর্দশার মূলে রয়েছেন হিন্দু পণ্ডিতদের একটা বড় অংশ। ১৯৫০ বা ৬০-এর দশকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একটা সংগঠন ছিল, জম্মু প্রজা পরিষদ। এটা কিন্তু আরএসএস-এর একটি শাখা ছিল। এর অধিকাংশ পদাধিকারী কিন্তু হিন্দু পণ্ডিত ছিলেন। তাই স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলন করা কাশ্মীরিদের সঙ্গে তাঁদের একটা বিরোধের জায়গা ছিল।  কাশ্মীরিদের নিপীড়নের একটা বড় কারণ ছিলেন পণ্ডিতরা, এটা মনে করত জঙ্গিরা। তাই যখনই কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন ওঠে, তখনই কুমীর ছানার মতো সামনে নিয়ে আসা হয় পণ্ডিতদের ইস্য়ুতে। বিষয়টা হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের জন্য়ই সামনে নিয়ে আসা হয়।  অনেকবেশি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে। এবং অর্ধসত্য়কে আশ্রয় করে, যা মিথ্য়ের চেয়েও ভয়ঙ্কর।

(ঘোষণা- এই লেখাটি লেখকের ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে, এর তথ্য এবং পরিবেশনা সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব অনুসন্ধানের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। এশিয়ানেট নিউজ নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম হিসাবে লেখাটিকে সকলের সামনে তুলে ধরেছে।)

Share this article
click me!