লাদাখ সীমান্ত যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে তার আঁচ পড়েছে মস্কোর শীতল আবহাওয়াতেও। আর এই পরিস্থিতিতেই বৃহস্পতিবার রাশিয়ার রাজধানীতে বৈঠকে বসলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। দুই দেশের বিদেশমন্ত্রীদের মধ্যে ২ ঘণ্টা ২০ মিনিট ধরা চলা এই বৈঠকে আদৌ শান্তির কোনও রোডম্যাপ মিললো কিনা, তাই নিয়েই এখন তোলপাড় হচ্ছে আর্ন্তাজাতিক রাজনীতি।
সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর বৈঠকে জয়শঙ্কর ও ওয়াং ই দুজনেই বৃহস্পতিবার মস্কোতে ছিলেন। সেখানেই মধ্যাহ্নভোজনে ত্রিপাক্ষিক স্তরে আলোচনায় বসেন ভারত, চিন এবং রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রীরা। আর সন্ধ্যায় বৈঠকে বসে ভারত এবং চিন। ভারতীয় সময় গভীর রাত পর্যন্ত চলে সীমান্তে শান্তি এবং সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য আলোচনা। জানা গিয়েছে, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে সেনা প্রত্যাহার ও উত্তেজনা হ্রাসে পাঁচটি বিষয়ে একমত হয়েছে ভারত ও চিন।
গত শুক্রবার মস্কোতেই চিনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর আহ্বানে বৈঠকে বসেছিলেন রাজনাথ সিং। সেই বৈঠকের পর বেজিংয়ের আস্ফালন ছিল সীমান্তে উত্তেজনার জন্য দায়ী ভারত। গত এক সপ্তাহে সেই উত্তেজনা আরও বেড়েছে। সীমান্তে গুলি চালানোর অভিযোগ উঠেছে চিনা সেনার বিরুদ্ধে। যদিও সেই অভিযোগ ভারতের ঘাড়ে দিতেই ব্যস্ত চিনের কুখ্যাত লালফৌজ। আর এই আবহেই মস্কোয় মুখোমুখি হন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও চিনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই। মস্কোয় দুই দেশের বিদেশমন্ত্রীদের থেকে সীমান্ত সমস্যার সমাধান আশা করেন নি কেউই। তবে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় তৈরি হওয়া উত্তেজনা এই বৈঠক কিছুটা প্রশমিত করতে পারে কিনা সেদিকেই তাকিয়ে ছিল সব পক্ষই।
বৈঠকের পরে যুগ্ম বিবৃতিতে ভারত ও চিন সরকারের তরফে ঐক্যমতে পৌঁছানোর বিষয়ে জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এযাবৎ দুই দেশের নেতাদের চেষ্টায় গড়ে ওঠা দ্বিপাক্ষিক সম্প্রীতি নষ্ট হয়, এমন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে দুই তরফই। বিশেষত সতর্ক থাকা হবে, মতান্তর যেন কোনও মতেই চূড়ান্ত পর্যায়ে না পৌঁছয়। দুই বিদেশমন্ত্রীই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, সীমান্ত সমস্যা কোনও পক্ষের কাছেই লাভজনক নয় এবং সেই কারণেই চিন ও ভারতের সামরিক পর্যায়ে বৈঠকের ভিত্তিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা থেকে অতিরিক্ত সেনা সমাবেশ সরানোর প্রক্রিয়া দ্রুত বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা হবে। সেই সঙ্গে দুই পক্ষের সেনা ঘাঁটির মাঝে ব্যবধান বাড়িয়ে উত্তেজনায় লাগাম দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে বৈঠকে।
বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, বৈঠকে জয়শঙ্কর তাঁর গভীর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ওয়াং-কে। সীমান্তে এই সংঘাতের সঙ্গে যে ভারত এবং চিনের সামগ্রিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে, সেই বার্তাও দিয়েছেন তিনি। সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হলে সীমান্ত থেকে সেনা সরাতে হবে চিনকে— এই বার্তাই কয়েক দিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে দিয়ে চলেছে দিল্লি, বৃহস্পতিবারের বৈঠকেও যার অন্যথা হয়নি।
এদিকে সাম্প্রতিক উপগ্রহচিত্র জানাচ্ছে, প্যাংগং হ্রদের দক্ষিণে ভারতীয় সেনার প্রতিরোধে পিছু হটার পরে এবার হ্রদের উত্তরের ফিঙ্গার এলাকায় আগ্রাসী ভূমিকায় চিনের কুখ্যাত লালফৌজ। ফের ফিঙ্গার-৪-এ ফিরে এসেছে তারা। বেজিংয়ের তরফে ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ‘ম্যাক্সার টেকনোলজিস’-এর ওই উপগ্রহ চিত্র। বৃহস্পতিবার দ্বিপাক্ষিক বৈঠক চলাকালীনও চিনের সরকারি মুখপত্র ‘গ্লোবাল টাইমস’ শাসিয়েছে, ভারতীয় সেনা যদি প্যাংগংয়ের দক্ষিণ পাড় থেকে না-সরে, গোটা শীতকাল জুড়ে চিন ‘প্রতিরোধ’ চালিয়ে যাবে।
এদিকে মস্কোয় দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আগে রাশিয়া-চিন-ভারতের ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে তিন দেশের সম্পর্ক মজবুক করার লক্ষ্যে আলোচনা করেছেন বিদেশমন্ত্রীরা। এক সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করে বিশ্বের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন তাঁরা। একে অপরের উন্নয়নে একে অপরের সহযোগিতার বার্তা দিয়েছে ভারত, চিন ও রাশিয়া।