পর্বতারোহণে বিশ্ব আঙিনায় আরও উজ্জ্বল হল বাঙালির উপস্থিতি, একান্ত সাক্ষাৎকারে অমিত চৌধুরী

  • এই প্রথম কোনও ভারতীয় স্থান পেল ইউআইএএ-এর শীর্ষ কমিটিতে
  • আর এর জন্য যে ভারতীয় নির্বাচিত হয়েছেন তাঁর নাম অমিত চৌধুরী
  • কলকাতার ছেলের অমিতের পর্বতারোহণের নেশা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে
  • সেখান থেকে বায়ুসেনায় চাকরি জীবনে পর্বতারোহণে এক উজ্জ্বল নাম হয়ে ওঠেন

Asianet News Bangla | Published : Oct 30, 2020 11:37 AM IST / Updated: Oct 30 2020, 07:57 PM IST

বিশ্বমঞ্চে ফের উজ্জ্বল বাঙালি। বিশ্ব পর্বতারোহণ সংস্থা ইউআইএএস বা ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইম্বিং অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন-এর এক্সিকিউটিভ বোর্ডের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন অমিত চৌধুরী। এই প্রথম কোনও ভারতীয় এই এক্সিকিউটিভ বোর্ডে স্থান পেল। এমনকী এর আগে কোনও বাঙালিও এই স্থানে পৌঁছতে পারেনি। অমিত চৌধুরী সেদিক থেকে একজন প্রথম বাঙালিও বটে যিনি এমন এক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন। বায়ুসেনার প্রাক্তন উইং কম্যান্ডার হিসাবে দীর্ঘ কর্মজীবন রয়েছে তাঁর। ছাত্রজীবন কেটেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ক্লাসে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পর্বতারোহণের ইচ্ছেকে বাস্তবায়িত করতে থাকেন অমিত। বায়ুসেনার প্রথম যে দল এভারেস্ট অভিযান করেছিল, তার নেতাও ছিলেন অমিত চৌধুরী। শুধু পর্বতারোহণ নয় স্কিং থেকে শুরু করে স্কাই- ড্রাইভিং-এর মতো অ্যাডভেঞ্চারাস স্পোটসেও তাঁর রয়েছে উজ্জ্বল উপস্থিতি। বর্তমানে হরিয়ানার গুরগাঁও-এর বাসিন্দা অমিত চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে ফোনালাপে মুখোমুখি এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সিনিয়র এডিটর দেবজ্যোতি চক্রবর্তী। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- পর্বতারোহণে ভারতবর্ষের একটা ঐতিহ্যশালী ইতিহাস রয়েছে। ইউআইএএ-তে সেটাকে কীভাবে কাজে লাগাবেন?

অমিত চৌধুরী- মূলত নলেজ শেয়ারিং-এর উপর জোর দিতে হবে। বিশেষ করে ভারতের পর্বতারোহণ-কে কীভাবে আন্তর্জাতিক স্তরে তুলে ধরে ধরা যায় সেটা অন্যতম একটা লক্ষ্য। ভারতের পাহাড়ের কথা আরও বেশি করে আন্তর্জাতিক আঙিনায় তুলে ধরতে হবে। আর এই সব পাহাড়কে ঘিরে যে সব জনবসতি রয়েছে তাদের কাহিনিও নিয়ে আসতে হবে সামনে। বিশ্বকে বোঝাতে হবে, ভারতের হিমালয়ের দুর্গম সব স্থানে বসবাসকারী এই মানুষগুলি কীভাবে প্রতিকূলতাকে জয় করে বেঁচে রয়েছে। কীভাবে তারা তাদের শারীরিক সক্ষমতাকে সুরক্ষিত করে রেখেছে। এর ফলে, যে সব মানুষ হিমালয়ের দুর্গমস্থানে ভ্রমণের কথা চিন্তা করেন, তারা এই সব জনজাতির মানুষগুলির কাছ থেকে একটা গাইডেন্স পেতে পারেন। আমরা জানি, হিমালয়ের বুকে কোনও শৃঙ্গে অভিযান করতে গেলে শেরপা-রা কতটা উপযোগী সহকারী। শেরপাদের মতই এমন আরও বহু জনজাতি রয়েছে। যাদের কথা বিশ্বের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এর আঙিনায় খুব কম লোকই জানে। চেষ্টা করব এই সব মানুষদের কথাকে সামনে নিয়ে আসার। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-  হাই মাউন্টেনিং ক্লাইম্বিং বলতে ভারত এবং চিলি, এছাড়া পৃথিবীর অন্যত্র এত হাই মাউন্টেনিং ক্লাইম্বিং হয় না, সেক্ষেত্রে এই ক্লাইম্বিং-এর ক্রস-শেয়ারিং নলেজকে কীভাবে কাজে লাগাবেন? 

অমিত চৌধুরী- ভারতে পর্বতারোহণের ইতিহাস ঊনিশ শতকের শেষদিকে। মূলত ব্রিটিশরাই হিমালয়ে প্রথম পর্বতারোহণ শুরু করেছিল। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয়রাও পর্বতারোহণে আসক্ত হয়েছে। আজ বিশ্বের কিছু দেশ পর্বতারোহণ করে। সেই সব দেশের তালিকায় ভারতও রয়েছে। কিন্তু, ভারতীয়রা মূলত হাই মাউন্টেনিং-এ ক্লাইম্ব করে। তুলনায় আল্পসে হিমালয়ের মতো সুউচ্চ শৃঙ্গ নেই। চিলি-তেও হাই মাউন্টেনিং হয়। কিন্তু, এক-এক দেশে পর্বতারোহণের পরিবেশ ও দুর্গমতা ভিন্ন ভিন্ন। হিমালয়ের বাইরেও যাতে ভারতীয়রা মাউন্টেনিং-এর দিকে বেশি করে ঝোকে, আবার সেইসঙ্গে ভারতের বাইরের মানুষও যাতে হিমালয়ের পর্বতারোহণের দুর্গমতা সম্পর্কে ভালো করে ওয়াকিবহাল থাকে, সেই বিষয়গুলিকে আরও কীভাবে পর্বতারোহীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় সেটাতেও নজর থাকবে। বহুদিন ধরে ইউআইএএ এই কাজগুলোই করে আসছে। নলেজ ক্রস শেয়ারিং তাই একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- বহুক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মানুষ উপযুক্ত সুরক্ষা এবং শারীরিক সক্ষমতা ছাড়াই এভারেস্ট-এর মতো শৃঙ্গে চড়ার চেষ্টা করছে, এতে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে, ইউআইএএ কীভাবে এতে কাজ করছে? 

অমিত চৌধুরী- ইউআইএএ-র সেফটি কমিশন বহুদিন ধরেই এর উপরে কাজ করছে। আমি নিজে সেফটি কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০১৭ সাল থেকে  কাজ করছি। পর্বতারোহণকে কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় তা নিয়ে নিরন্তর কাজ চলছে। পর্বতারোহীদের শিক্ষিত করার চেষ্টা চলছে। এটা যে শুধু হিমালয়ের পর্বতারোহণ হচ্ছে এমনটা নয়, বিশ্বজুড়েই এই কর্মযজ্ঞ চলছে। সমস্যা হচ্ছে ভারতের বেশকিছু রাজ্যে এভারেস্ট জয়ের সার্টিফিকেট থাকা মানুষদের সরকারি চাকরি দেওয়ার চল রয়েছে। এর লোভে পড়ে অনেকেই ভিটে-মাটি, সম্পত্তি বিক্রি করে এভারেস্ট জয় করতে ছুটছে। অনেকে আবার এভারেস্ট জয় না করেই ফেক ফোটো বানিয়ে জালিয়াতিরও চেষ্টা করছে। এমন ঘটনা বারবার সামনে আসছে। তো যারা এই ধরনের কাজ করছে তাদের সংখ্যাটা বিশাল কিছু নয়। তবে, হ্যাঁ এটা উদ্বেগের যে এভারেস্টের এলাকার মধ্যে যদি যখন এই সব ঘটনা ঘটছে। একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে পেশাদার মাউন্টেনিং কোনও ওয়ান নাইট অ্যাচিভমেন্ট নয়। এটা একটা প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়াকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়। যখনই কেউ এই প্রক্রিয়াকে অগ্রাহ্য করে অ্যাচিভমেন্টের লোভে তাকে ফাস্টট্র্যাক করার চেষ্টা করে, তখনই সব সমস্যা তৈরি হয় এবং নানা ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। পর্বতারোহণের প্রক্রিয়ায় এই ফাস্ট ট্র্যাক প্রসেসকে বাদ দিতেই হবে। চেষ্টা করা হচ্ছে যে সকলে যেন সুরক্ষিত উপায়ে পর্বতাভিযান করতে পারে। আমরা সেই নিয়েই বহুবছর ধরেই কাজ করছি। এই নিয়ে আমি কিছু ব্লগও লিখেছি। সর্বভারতীয় ইংরাজি সংবাদমাধ্যমে সেই ব্লগ প্রকাশিত হয়েছে। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলা-  একটা সময় পশ্চিমবঙ্গে স্কাউট এবং মাউন্টেনিয়ারিং-এর বিশাল একটা উন্মাদনা ছিল। স্কুলে-স্কুলে এবং ক্লাবেও এর উন্মদনা চোখে পড়ত। এখন কী এতে ভাটা এসেছে? 

অমিত চৌধুরী- এমনটা আমি বলব না যে ভাটা এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে এখন মাউন্টেনিংয়ারিং-এর উন্মাদনাটা ষোলগুণ বেড়েছে। পাড়ায়-পাড়ায় অসংখ্য মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব তৈরি হয়েছে। প্রচুর বাঙালি শুধু এভারেস্ট নয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেও পর্বতাভিযানে অংশ নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের বুকে এই মুহূর্তে অসংখ্য ভালো পর্বতারোহী রয়েছেন, যাদের আন্তর্জাতিক স্তরে একটা পরিচিতিও তৈরি হয়েছে। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- নিজের মধ্যে পর্বতারোহণের এই নেশাটাকে কীভাবে গড়ে তুলেছিলেন? 

অমিত চৌধুরী- ছোট থেকেই পর্বতাারোহণের একটা শখ ছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন এই ইচ্ছেটা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতেই রয়েছে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাব। তাদের সংস্পর্শে পর্বতারোহণের নেশাটা আরও মারাত্মক আকার নিয়েছিল। এরপর আস্তে আস্তে বিভিন্ন পর্বতাভিযানে অংশগ্রহণ। সঙ্গে সঙ্গে পর্বতারহণ নিয়ে ধাপে ধাপে প্রশিক্ষণও নিয়েছি। কর্মজীবনে বায়ুসেনাতে থাকালীন পর্বতারোহণের সঙ্গে নানা ধরনের অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস-এও অংশগ্রহণ করেছি নিয়মিত। যার জন্য স্কিং থেকে শুরু করে স্কাই-ড্রাইভিং-এর একজন্য উজ্জ্বল ক্রীড়াবিদ হিসাবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলাম। বায়ুসেনার হয়ে বিভিন্ন পর্বতাভিযানে অংশ নিয়েছি। ১৯৯২  থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত গুলমার্গ-এর ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অফ স্কিং মাউন্টেনিয়ারিং-এর প্রিন্সপ্যাল হিসাবে কাজ করেছি। ২০০৫ সালে বায়ুসেনার প্রথম এভারেস্ট অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছি। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বায়ুসেনার অ্যাডভেঞ্চার উইং-এর ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেছি। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশনের ভাইস প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি হিসাবেও কাজ করেছি। এই মুহূর্তে ইউআইএএ-র সেফটি কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০১৭ সাল থেকে কাজ করছি। ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনের স্টিয়ারিং কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবেও কাজ করছি। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলা- অর্জুনা অ্যাওয়ার্ড-এর অন্যতম অঙ্গ তেনজিং নোরগে সম্মানেও সম্মানিত হয়েছেন আপনি। পর্বতারহোণে অবদানের জন্য ২০১৪ সালে লাইফটাইম কন্ট্রিবিউশন হিসাবে এই সম্মান আপনাকে প্রদান করা হয়েছিল। সুতরাং, স্বাভাবিকভাবেই ইউআইএএ-র এক্সিকিউটিভ বোর্ডে প্রথম ভারতীয় হিসাবে আপনার স্থান পাওয়াটা দেশের কাছে যথেষ্টই সম্মানের। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। 

অমিত চৌধুরী- শুধু পর্বতারোহণ নয় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসকে তুলে ধরা নিয়েই কাজ করার চেষ্টা করেছি। এখনও চেষ্টা করে যাবো। আপনাদেরও অসংখ্য ধন্যবাদ। 

Share this article
click me!