রতন টাটার পাশে থাকা ২৮ বছর বসয়ী ওই তরণ কে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অনেকেই ভেবেছিলেন ওই তরুণ টাটার পরিবারের কোনও সদস্য। কিন্তু, আদতে তা একেবারেই নয়। আসলে ওই যুবকের নাম শান্তনু নায়ডু।
ভারতের (India) অন্যতম সফল শিল্পপতি (Industrialist) হলেন রতন টাটা (Ratan Tata)। সফলতার শীর্ষ ছোঁয়ার পরও অত্যন্ত মাটির মানুষ তিনি। প্রত্যেক কর্মীর (Staff) কাছে তিনি খুবই প্রিয়। আপদে-বিপদে সব সময় কর্মীদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় তাঁকে। এমনকী, কর্মীদের সঙ্গে তিনি মেলামেশাও করেন খুবই সহজভাবে। ২৮ ডিসেম্বর ছিল তাঁর ৮৪ বছরের জন্মদিন (Birthday)। আর সেই দিনে তাঁকে কেক কাটতে দেখা গিয়েছিল ২৮ বছর বয়সী এক তরুণের সঙ্গে। সেই জন্মদিনে ছিল না কোনও জাঁকজমক। উপস্থিত ছিলেন না কোনও তারকা অতিথিও। এহেন এক ব্যক্তিত্বর জন্মদিন পালন করা হয় ছোট্ট একটি কাপ কেকের (Cup Cake) উপর একটি মাত্র মোমবাতি জ্বালিয়ে। পাশে ছিলেন শুধু এক তরুণ। তাঁকে অবশ্য স্কুল ছাত্র (School Student) বলেই চালিয়ে দেওয়া যায়। আসলে তিনিই ছিলেন এই জন্মদিনের আয়োজক ও অতিথি। আর রতন টাটার এই জন্মদিনের ভিডিও ভাইরাল (Viral Video) হওয়ার পরই আলোচনা শুরু হয় ওই তরুণকে নিয়ে।
রতন টাটার পাশে থাকা ২৮ বছর বসয়ী ওই তরণ কে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। অনেকেই ভেবেছিলেন ওই তরুণ টাটার পরিবারের কোনও সদস্য। কিন্তু, আদতে তা একেবারেই নয়। আসলে ওই যুবকের নাম শান্তনু নায়ডু (Shantanu Naidu)। তিন টাটা গোষ্ঠীর পঞ্চম প্রজন্মের এক কর্মী। এই মুহূর্তে তিনি রতন টাটার খুব কাছের মানুষ। তাঁর প্রিয় বন্ধু। দু'জনের বয়স যাই হোক না কেন, সেই সংখ্যার বেড়াজালের মধ্যে আটকে যায়নি তাঁদের বন্ধুত্ব। আর সেই কারণেই বেশিরভাগ সময়ই টাটার পাশে দেখা যায় শান্তনুকে।
রতন টাটার অফিসের একন কর্মী শান্তনু। কিন্তু, কীভাবে এই যুবকের সঙ্গে পরিচয় হল রতন টাটার? পুণের বাসিন্দা শান্তনু একজন মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার (Mechanical Engineer)। পড়াশোনা পুণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। টাটাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ২০১৪ সালে স্নাতক পাশ করার পর টাটা গ্রুপের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন শান্তনু। পাশাপাশি সময় পেলেই রাস্তার কুকুরদের (Street Dog) দেখভাল করতেন। একদিন রাস্তার মাঝে একটি কুকুরকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারিয়েছিল কুকুরটি। এই ঘটনায় খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন শান্তনু। কীভাবে এই দুর্ঘটনার হাতে থেকে পথ কুকুরদের রক্ষা করবেন তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করেন।
আরও পড়ুন- অ্যামজন-ফ্লিপকার্টের সেল শুরু ১৭ জানুয়ারি, Offer সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন
স্বভাবে পশুপ্রেমী জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ঠিক করেন এর সমাধান করবেন। তার জন্য প্রথমে পথচলতি গাড়ির চালকদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। জানা যায়, রাতে গাড়ি চালানোর সময় কুকুরগুলিকে চট করে দেখতেই পান না চালকরা। ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। সমস্যা জানার পর সমাধানের পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। তারপর ঠিক করেন রাস্তার কুকুরদের আলো জ্বলা কলার পরানো হবে। যাতে রাতের অন্ধকারেও তাদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু, কলার বানাবে কে? কেই বা পরাবে? অফিসের কাজ সামলে একার পক্ষে এত কাজ করা সম্ভব নয়। তবে এই সমস্যারও সমাধান বের করে ফেলেন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার। রাস্তার কুকুরদের দেখভালের জন্য বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করে ফেলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘মোটোপজ’। আর এই সংস্থাই তাঁর জীবন বদলে দিয়েছিল।
এদিকে সংস্থা তৈরি হলেও সেই কলার তৈরি করার জন্য তাঁদের কাছে পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। এরপর স্থানীয়দের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছেঁড়া জিন্স জোগাড় করে আনেন শান্তনুরা। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে তাতে জোড়া হয় অন্ধকারে জ্বলে এমন কাপড়। আর এভাবেই পথ কুকুরদের জন্য তৈরি হয় কলার। এই উদ্যোগ পুণের টাটা এলেক্সি কর্তৃপক্ষের নজর কেড়েছিল। সংস্থার নিউজলেটারে জায়গা করে নেয় ঘটনাটি। নজরে পড়ে তৎকালীন চেয়ারম্যান রতন টাটারও।
রতন নিজেও পশুপ্রেমী। এদিকে শান্তনুদের এই কাজ প্রশংসিত হলেও কুকুরদের জন্য কলার তৈরি করার মতো টাকা তাঁদের কাছে ছিল না। তারপর বাবার কথায় রতন টাটাকে চিঠি লেখেন শান্তনু। নিজেদের উদ্যোগের কথা জানিয়ে টাটাকে চিঠি লেখেন তিনি। এর ঠিক দু'মাস পর উত্তর আসে। এ প্রসঙ্গে শান্তনু বলেন, "আমার জীবন বদলে গিয়েছিল, আমি রতন টাটার সই করা চিঠি পেয়েছিলাম। চিঠিতে লেখা ছিল যে তাঁর আমাদের এই কাজ ভালে লেগেছে, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।" এভাবেই ধীরে ধীরে রতন টাটার সঙ্গে শান্তনুর পরিচয় তৈরি হয়। তাঁদের সংস্থাকে অর্থ সাহায্য করেন রতন। তবে টাটা গোষ্ঠীর তরফে নয়। শান্তনুদের রতন সাহায্য করেছিলেন ব্যক্তিগত ভাবে। সম্পূর্ণ নিজের অর্থ থেকে।
এরপরই ধীরে ধীরে শান্তনুর সঙ্গে রতন টাটার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। মেলে প্রায়শই কথা হতে থাকে দু’জনের। প্রথমে তাঁদের সংস্থার কাজ নিয়ে, পরে ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিষয়ে ভাবনাচিন্তা বিনিময় হয়। এমনকী, একটা সময়ে ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্নোত্তরের পর্যায়েও পৌঁছে যায় কথাবার্তা। কিন্তু, তারপরই টাটার গ্রুপ ছেড়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন শান্তনু। অবশ্য তখনও টাটার সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বে কোনও ছেদ পড়েনি।
পড়া শেষে দেশে ফেরেন শান্তনু। তারপরই ফোন পান রতন টাটার থেকে। শান্তনুকে তাঁর সঙ্গে কাজ করার প্রস্তাব দেন রতন। তাঁর ব্যক্তিগত বিজনেস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন শান্তনু। গাঢ় হতে থাকে দুই অসম বয়সীর বন্ধুত্ব। রতনের যে বিষয়টি শান্তনুকে বিস্মিত করে, তা হল তাঁর লক্ষ্যে স্থির থাকা। শান্তনুর কথায়, "উনি টানা কাজ করে যেতে পারেন। নন-স্টপ। নো ব্রেক। তাই আমি তাঁকে মিলেনিয়াল ডাম্বলডোর বলে ডাকি। আমার মনে হয় এই নামটাই তাঁর সঙ্গে যায়।"
দু'জনের মধ্যে বয়সের ফারাক থাকলেও তা বুঝতে দেন না তাঁরা কেউই। সেই ফারাকটাকে অনায়াসেই কাটিয়ে ওঠেন তাঁরা। তবে মাঝে মধ্যেই তাঁদের আড্ডা চলে কাজের বাইরেও। একসঙ্গে সিনেমা দেখেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে নিজেদের চিন্তা ভাবনার সহজ বিনিময় করেন দু’জনে। আসলে বয়স যে শুধুমাত্রই একটা সংখ্যা তা প্রমাণ করে দিয়েছেন তাঁরা।