আফগানিস্তান যুদ্ধ- ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু, আমেরিকার একটি অকাল যুদ্ধের অবসান

ওসামাকে হত্যা করা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নৈতিক বিজয় ছিল তবে তা থেকে কোনও কিছুই অর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেও মনে হয়। এটি ইরাকের মতোই একটি ভুল- একটি অকাল সংঘাতের অবসান, বলছেন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন। 

Asianet News Bangla | Published : Jul 12, 2021 10:10 AM IST / Updated: Jul 12 2021, 04:40 PM IST

অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন, গত দুই দশক ধরে যুদ্ধ বিধ্বস্ত আফগানিস্তান। আগামী দিনে আফগানিস্তানের এই সংঘর্ষ একাধিকবার একাধিক দৃষ্টকোন থেকে ব্যাখা করা হয়ে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনীর কৌশলগত ব্যর্থতা হিসেবে তা নথিভুক্ত হবে। 

বিষয়গুলিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার আর মুছে ফেলার শক্তি কারও নেই। আফগানিস্তানের নাম করা শিরোনাম - 'সাম্রাজ্যের করবস্থান' সম্ভবত একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে নেতৃত্ব কৌশল আর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হবে। রিচার্জ নিক্সনের ভিয়েতনাম অভিযান যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কাছে আজও একটি তিক্ত স্মৃতি তেমনই আফগানিস্তানও একটি তিক্ত স্মৃতি হিসেবেই স্থান পাবে। 

আফগানিস্তানে মার্কিন ব্যর্থতার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত খুব কম উপাদান নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল মার্কিন বাহিনী। রেইকি না করেই রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল। ভার্চুয়ারি গোটা বিষয়টি দেখা হয়েছিল। বর্তমানে সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি স্পষ্টতা পাওয়া গেলেও সেই ডোমেনটির একটি পৃথক অন্বেষণ যাথাযথভাবে করা হবে। 


গত সাত -আট বছর ধরে ন্যাশানাল ইউনিটি সরকারকে তালিবান বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে শক্তিশালী করার একাধিক প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। একই সঙ্গে বিশ্বের কাছেও তা তুলে ধরা হয়েছিল। একটি 'আফগান নেতৃত্বাধীন ও আফগান মালিকানাধীন সমাধান' বিশেষজ্ঞদের দ্বারা প্রায়ই চূড়ান্ত কাউন্টার হিসেবে উদ্ধৃত করা হত। এগুলির কোনওটিই কাজ করে বলে এখন মনে হয় না। যদিও কেউ কেউ এখনও দাবি করছেন যে উদীয়মান লড়াইয়ে কিছু বলা খুব ঠিক নয়। 


আফগান ন্যাশানাল আর্মি (ANA) আর আফগান ন্যাশানাল পুলিশের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ লক্ষ। তাদের শক্তি আর  সহস মোটেও কম ছিল না। গত কয়েক বছর তালিবান হামলা প্রতিহত করেছে। প্রতিবছর গড়ে ৮ হাজার জওয়ানের প্রাণ গেছে। আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিমান চালানোর পরেও এই ঘটনা ঘটেছে। 

আমাদের অনেকেরই প্রশ্ন আফগান ন্যাশানাল আর্মি একা লড়াইয় করতে সক্ষম কিনা? এই প্রশ্নের উত্তর ২০১৩ সালে ছিল না। তার জন্য যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেই ক্ষমতা অর্জনে কেন তাদের কোনও সুবিধে দেওয়া হয়নি? কিন্তু তাদের উন্নতমানের সামরিক সরঞ্জামগুলি দেওয়া হয়নি। মনে করা হত তাদের অস্ত্র আর যুদ্ধ সরঞ্জাম দিলে তা তালিবানদের হাতে গিয়ে পড়বে। আর তালিবানদের শক্তি বাড়াবে। 

ভারতের কাছ থেকে প্রায়ই কিছু ভারী অস্ত্র, গোলাবারুদ,  আর হেলিকপ্টার দেওয়ার আহ্বান জানান হয়েছিল। আফগান ন্যাশানাল আর্মির সঙ্গে আমাদের একটি স্থানীয় আর ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। আফগান সরকারও আমাদের দেশের রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো রাখতে চায়। সেই কারণে ভারতও আফগান অফিসার আর ক্যাডেট আর সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অস্ত্র হেলিকপ্টারও দিয়েছে। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখার জন্য খাবারও পাঠান হয়েছিল। অবশেষে এমন একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিল যে আফগানরা সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করেছিল ভারতকে। কিন্তু মার্কিন বাহিনীর দাপট আর তালিবানদের সঙ্গে সম্পর্কের মধ্যে ভারত তেমন এগিয়ে যেতে পারেনি। ভারি অস্ত্র সরবরাহ করেনি। 

এদেশে শিশুদের করোনা টিকা আসতে দেরি,৩ ডোজের ZyCov-D অনুমোদনে আরও সময় লাগবে
তারপরে এখনও কিন্তু আফগান সেনা তালিবানদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে। কারণ তাদের হাতে আধুনিক যুদ্ধ বিমান রয়েছে। লজিস্টিক সাপোর্টও রয়েছে। তাই ভারী অস্ত্র কোনও বাধা হতে পারে না। তবে তালিবানরাও এবার শহরগুলিকে যখন টার্গেট করছে তখন পুরনো কৌশল অবলম্বন করছে না। তারা প্রথমে সর্বাধিক সংখ্যাক গ্রামীণ জেলাকে ধরে রাখতে চেয়েছে। তারপরেই হাত বাড়িয়েছে শহরের দিকে। প্রথমই তালিবানরা শহর এলাকার সাপ্লাই লাইন বন্ধ করার জন্য কাজ করছে। যাতে সমস্যায় পড়েছে শরণার্থী আর অভ্যন্তরীনভাবে বাস্তুচ্যুতরা। এটি একটি মানবিক সংকট তৈরি করছে। অশান্তি আর বিশৃঙ্খলা সরকারকে অস্বীকার করবে এবং তালিবানদের সহায়তা করবে - যা তারা চাইছে। 

প্রবল বজ্রপাত মৃত্যু ৬৮ জনের, নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানালেন প্রধানমনমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী

৯/১১ সন্ত্রাসবাদী হামলার জবাব দিতে আর প্রতিশোধ নিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক অভিযান শুরু করেছিল। কিন্তু মার্কিন তরফে বলা হয়েছিল সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে এটাই বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ। নাম দেওয়া হয়েছিল - এন্ডুরিং ফ্রিডম। মার্কিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হামলার অন্যতম মাথা ওসামা বিন লাদেনকেও মার্কিন সেনা হত্যা করেছিল। মার্কিন সেনার কাছে ছিল এটা নৈতিক জয়। কিন্তু তা ছাড়া আর কোনও লাভ হয়নি। 

এটি সম্ভবত এটাই ইঙ্গিত করে যে আমেরিকা ইরাকের মত একই ভুল করেছে। এটি অকাল দ্বন্দ্বের অবসান। ইরাকের ক্ষেত্রে এটি ব়্যাডার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। এভাবেই ইসলামিক স্টেটের উত্থানকে সক্ষম করে। যা আজও একটি পাকা খেলোয়াড় হিসেবে অব্যাহত হয়েছে। ২০ বছর পর সেনা প্রত্যাহার অকাল দ্বন্দ্বের অবসান হিসেবে বিবেচিত হবে না। 

যাইহোক, এটি বিগত বহু বছর মার্কিন উপস্থিতির তুলনামূলক কার্যকারিতা যা প্রশ্ন করা উচিৎ। বারাক ওবামা কৃপণতার সঙ্গে সেনা মোতায়েন করেছিলেন। পরবর্তীকালে সেনা ধীরে ধীরে বাড়ান হয়েছিল। এটি সর্বদাই একটি অনিচ্ছুক উপস্থিতি ছিল। প্রথম থেকেই তালিবাদের কাছে স্পষ্ট ছিল। তাঁরা জানতে স্ট্যামিটা ধরে রাখতে পারলে জয় তাদের হাতেই ধরা দেবে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংশোধনী আনতে কিছুটা হলেও দেরি করেছে। তালিবানদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। আর তা পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশরাফ গানির নেতৃত্বাধীন সরকারের পাশেও পুরোপুরি দাঁড়ায়নি। সবকিছুর মধ্যেই থেকে গেছে অস্পষ্টতা। 

গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই তারি হয়েছে। ১২০টিরও বেশি জেলা তালিবানদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আফগান দলগুলি তেহরানে আলোচনার পরেও তালিবানরা পুরোপুরি নয়ন্ত্রকের ভূমিকায় রয়েছে। এখন সময়টা বড়ই কঠিন। 

ব্রিটিশ ধনকুবেরের মাহাকাশ সফর, ভার্জিন গ্যালাকটিকে চড়ার অভিজ্ঞতা জানালেন রিচার্ড ব্রানসন

পাকিস্তান বিমানবন্দরে জন্য কোনও চুক্তি নেই বলে মনে করা হচ্ছে। তাই সেখান থেকে সেনা বাহিনীর প্রতিরোধকে আরও শক্তিশালী করার জন্য কিছু মার্কিন বিমান সহায়তা পাওয়া যাবে। ড্রোনও পাওয়া যাবে। সেনা বাহিনী স্থায়ী না হওয়া পর্যন্ত উত্তর পশ্চিম ভারত মহাসাগরে যে মার্কিন সামরিক বাহিনী রয়েছে সেখান থেকে বিমান সমর্থন পাওয়া যাবে। 

আফগানিস্তানে সোভিয়েত আর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রসহ বন্ধু দেশগুলির কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। দীর্ঘ সময় লড়াইয়ের ইচ্ছে, একসঙ্গে সমস্ত অঞ্চলকে সম্বোধন করা, অঞ্চল দখল করা, সামাজিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্র গড়ে তোলার ধারনাটি অনুসরণ করার ধারনা ছিল। এই সবকিছুর মধ্যে যে এটি সংজ্ঞাবদ্ধ সিদ্ধান্তটি দাড়িয়েছিল তা হল আফগানিস্তানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। আগামী দিনে আফগানিস্তান নিয়ে আরও অনেক আলোচনা হবে। 

(লেখকঃ অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল সৈয়দ আতা হাসনাইন, শ্রীনগরের ১৫ কর্পসের প্রাক্তন কমান্ডার। বর্তমানে কাশ্মীরের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর।) 

Share this article
click me!