
বেজিং: দীর্ঘ ২০ বছরের মার্কিন জিপিএস (GPS) নির্ভরতা কাটিয়ে নিজস্ব উপগ্রহ নেভিগেশন সিস্টেম 'BeiDou' (বেইডু)কে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছে চীন। শুধু তাই নয়, চীনের দাবি, তাদের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ইতিমধ্যেই বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশে জনপ্রিয় হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে নেভিগেশন পরিষেবায় চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের পথ প্রশস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই পদক্ষেপকে চীনের প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতার এক বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। একসময় নেভিগেশনের জন্য পুরোপুরি মার্কিন জিপিএস-এর উপর নির্ভরশীল ছিল বেজিং। কিন্তু এখন বেইডু সিস্টেম তাদের সামরিক, বেসামরিক এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
সম্প্রতি চীন তাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেম 'BeiDou' (বেইডু)-এর ২০২৪ সালের তথ্য প্রকাশ করেছে, যা কেবল একটি প্রযুক্তিগত অগ্রগতির হিসাবনিকাশ নয়, বরং গত দুই দশকে মার্কিন জিপিএস (GPS)-এর একটি নির্ভরযোগ্য বিকল্প তৈরি করে চীনের ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার এক ঝলক দেখিয়ে দিয়েছে।
মার্কিন GPS-কে টেক্কা দিয়ে বেইডুর বৈশ্বিক জয়যাত্রা:-
১৯৯০-এর দশকে একটি সামরিক প্রকল্প হিসাবে বেইডুর যাত্রা শুরু হলেও, এটি এখন চীনের প্রযুক্তিগত ও কূটনৈতিক কৌশলের মূল ভিত্তি হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের (UN) দ্বারাও এটি একটি বৈশ্বিক নেভিগেশন প্রদানকারী হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, চীন শুধু স্যাটেলাইট নেভিগেশনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ওপর থেকে তাদের নির্ভরতা ভাঙেনি, বরং বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশকে তাদের এই নেটওয়ার্কে যোগ দিতে উৎসাহিত করেছে! এটি কেবল প্রকৌশলীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং একটি স্পষ্ট উদাহরণ যে, কীভাবে চীন তার প্রযুক্তিগত দুর্বলতা কমাতে শিখেছে।
বেইডুর উত্থান এবং চীনের কৌশল:-
শুরুতে চীনের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেইডু তৈরি করা হলেও, এর বাণিজ্যিক ও বেসামরিক প্রয়োগও ব্যাপক। ২০২৪ সালের তথ্যানুসারে, চীনের স্যাটেলাইট নেভিগেশন খাত থেকে প্রায় ৭৯.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ৭.৪% বেশি। প্রতিদিন এক ট্রিলিয়নেরও বেশি লোকেশন রিকোয়েস্ট এই সিস্টেম প্রসেস করে এবং ৪ বিলিয়ন কিলোমিটারের বেশি নেভিগেশন পরিচালনা করে। বর্তমানে প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন চীনা মোবাইল ফোনে বেইডু সিস্টেম সমন্বিত করা হয়েছে। এটি দেশের ৯৯% শহুরে ও গ্রামীণ সড়কে লেন-স্তরের নির্ভুলতা (lane-level precision) প্রদান করে, যা প্রচলিত জিপিএস-এর চেয়ে অনেক বেশি উন্নত।
কূটনৈতিক প্রভাব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রসারণ:-
বেইডু এখন চীনের বিদেশ নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমেরিকার ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি, চীন এটিকে নিজেদের বৈশ্বিক প্রভাব বিস্তারের কাজে লাগাচ্ছে। বিশেষত, আফ্রিকার ৩০টিরও বেশি দেশ বেইডু কন্টিনিউয়াসলি অপারেটিং রেফারেন্স স্টেশন (CORS) স্থাপন করেছে, যা তাদের কৃষি, জল ব্যবস্থাপনা এবং আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে উচ্চ-নির্ভুল পরিষেবা দিচ্ছে। ল্যাটিন আমেরিকার পেরুর চানকে বন্দর "5G + BeiDou উচ্চ-নির্ভুল অবস্থান + AI" প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রথম স্মার্ট বন্দর হিসাবে গড়ে উঠেছে। এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক অঞ্চলে, যেখানে জিপিএস কভারেজ দুর্বল, সেখানে বেইডু চীনের পরিবহন ও লজিস্টিক পরিষেবাগুলিকে শক্তিশালী করছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, স্যাটেলাইটের সংখ্যা, সংকেতের শক্তি এবং অনেক ক্ষেত্রে অবস্থানের নির্ভুলতার দিক থেকে বেইডু ইতিমধ্যেই জিপিএস-কে ছাড়িয়ে গিয়েছে। বেইডুর বর্তমানে কক্ষপথে ৫৬টি স্যাটেলাইট রয়েছে, যা জিপিএস-এর ৩১টি স্যাটেলাইটের প্রায় দ্বিগুণ। এছাড়াও, বেইডু নক্ষত্রপুঞ্জটি নতুন প্রজন্মের, যেখানে জিপিএস এখনও ১৯৯০-এর দশকের স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। বেইডুকে বিশ্বজুড়ে জিপিএস-এর চেয়ে প্রায় দশগুণ বেশি পর্যবেক্ষণ স্টেশন দ্বারা সমর্থিত করা হয়, যারফলে অনেক স্থানে বেইডুর নির্ভুলতা উল্লেখযোগ্যভাবে ভালো।
চীনের প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন মোবাইল ফোনে ইতিমধ্যেই বেইডু সিস্টেম সংযুক্ত করা হয়েছে। এর ফলে দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ দৈনন্দিন জীবনে এই দেশীয় প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, বেইডু চীনের ৯৯% শহুরে এবং গ্রামীণ সড়কে লেন-স্তরের নির্ভুলতা (lane-level precision) সহ কভারেজ সরবরাহ করে, যা প্রচলিত জিপিএস (GPS) প্রযুক্তির চেয়েও অনেক উন্নত। এর অর্থ হলো, বেইডু ব্যবহার করে গাড়ি বা অন্যান্য যানবাহন রাস্তায় কোন লেনে চলছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব, যা প্রচলিত জিপিএস ব্যবস্থায় সচরাচর সম্ভব নয়।
এই নির্ভুলতা কেবল ব্যক্তিগত পরিবহনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং কৃষি, লজিস্টিকস এবং জরুরি পরিষেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতেও বেইডুর ব্যবহারকে অপরিহার্য করে তুলেছে। চীনের এই প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতা তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল করছে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চীনের প্রভাব বিস্তারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বেইডু এখন শুধু একটি নেভিগেশন সিস্টেম নয়, এটি চীনের কৌশলগত সক্ষমতা এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতীক।
বেইডু কি চীনের কূটনৈতিক অস্ত্র?:-
বর্তমানে আমেরিকা চাইলেও চীনের স্যাটেলাইট নেভিগেশন সিস্টেমে প্রবেশাধিকার বন্ধ করতে পারবে না, যা বেজিংয়ের জন্য একটি দারুণ কূটনৈতিক জয়। এটি চীনের পক্ষ থেকে একটি সুচিন্তিত এবং কার্যকর জবাব, যা তাদের প্রযুক্তিগত স্বনির্ভরতাকে নিশ্চিত করেছে।
তবে চীন বেইডু প্রকল্পকে কেবল শুরু হিসেবে দেখছে, যা তাদের বৈশ্বিক সম্প্রসারণের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ। এই মহাপরিকল্পনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং সবুজ শক্তি (green energy) সহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বেইডুর মাধ্যমে চীন শুধু অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে না, বরং তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাবও বিশ্বজুড়ে বাড়ছে। বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশকে বেইডু নেটওয়ার্কে যুক্ত করার মাধ্যমে বেজিং তাদের প্রভাব আরও বিস্তৃত করছে। এই দেশগুলো এখন নেভিগেশন এবং অন্যান্য সম্পর্কিত পরিষেবার জন্য চীনের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের এই ধারাবাহিক কৌশলগত পদক্ষেপগুলো ভবিষ্যতের বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। বেইডু যেমন চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির মাধ্যমে বৈশ্বিক মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে, তেমনি অন্যান্য প্রযুক্তিগত খাতেও তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট। আগামী দিনে চীন কিভাবে এই প্রযুক্তিগত সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে আরও সুসংহত করে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
আরও খবরের জন্য চোখ রাখুন এশিয়ানেট নিউজ বাংলার হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে, ক্লিক করুন এখানে।