
নেপালে দুর্নীতি এবং সোশ্যাল মিডিয়ার উপর জারি করা নিষেধাজ্ঞার জেরে গত ৮ সেপ্টেম্বর থেকে এর প্রতিবাদে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। উত্তেজিত জনতা সংসদ ভবনে ঢুকে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২১ জনের প্রাণহানি হয় এবং ২৫০-এর বেশি মানুষ আহত হয়েছে। জনগণের ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের মুখে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলিকে পদত্যাগ করতে হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ ও আন্দোলনের জেরে বহু রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং উচ্চপদস্থ নেতাদের জনগণের ক্ষোভের শিকার হতে হয়েছে। এই আন্দোলনগুলি সাধারণত সেইসব দেশে ছড়িয়ে থাকা দুর্নীতি, অরাজকতা, অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা অথবা ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে ঘটে থাকে। বিশ্বজুড়ে এমন ১০টি বড় আন্দোলন সম্পর্কে জানুন। যা রাষ্ট্রপ্রধানদের সিংহাসন পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়, যা ধীরে ধীরে গণআন্দোলনে পরিণত হয়। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনকারীরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনে হামলা চালায়। এরপর গত বছরের ৮ অগাস্ট তাঁকে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়।
ভারতের প্রতিবেশী এই দ্বীপরাষ্ট্রেও ২০২২ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলন ব্যাপক ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন ছিল অর্থনৈতিক সংকট, অর্থনীতির অব্যবস্থা এবং দুর্নীতির কারণে জনগণের মধ্যে ক্ষোভের বিস্ফোরণ। যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কয়েক মাস ধরে চলা অস্থিরতার পর, আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে হামলা চালায়। এর ফলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকেও পদত্যাগ করতে হয়, যার পর ক্ষমতা হস্তান্তর হয়।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর বেসামরিক শাসন ফিরিয়ে আনার দাবিতে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ মিছিল করে। সুদানীয় জনগণের সেবায় নিয়োজিত একটি বেসামরিক-গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এর জবাবে, তাদের সেনাবাহিনীর প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের শিকার হতে হয়, যেখানে ৫৩ জন নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হন। পরবর্তীতে সুদানের ১৫তম প্রধানমন্ত্রী আবদুল্লাহ হামদোক একটি মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটের হুঁশিয়ারি দিয়ে তার পদ থেকে ইস্তফা দেন।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আলজেরিয়ায় শুরু হওয়া গণবিক্ষোভ, যা 'হিরাক' আন্দোলন নামে পরিচিত, অবশেষে সফল হয়। ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ এবং প্রেসিডেন্ট আবদেলআজিজ বুতেফ্লিকার পঞ্চমবারের জন্য নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তাঁর ক্ষমতার আঁকড়ে থাকার চেষ্টা জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি করে। আন্দোলনকারীরা, যাদের মূল দাবি ছিল দুর্নীতির অবসান এবং বুতেফ্লিকার পদত্যাগ, শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ চালিয়ে যায়। প্রায় দুই মাস ধরে চলা এই লাগাতার প্রতিবাদের মুখে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে বুতেফ্লিকা শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।
২০২০ সালে কিরগিজস্তানে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, তার মূলে ছিল সে দেশের সংসদীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে, যা জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের জন্ম দেয়। প্রতিবাদে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং বিক্ষোভ সহিংস রূপ ধারণ করে। বিক্ষোভকারীরা সরকারি ভবনগুলোতে হামলা চালায় এবং এক পর্যায়ে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সুরনবে জিনবেকোভ শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার পদত্যাগের পর সাদির জাপারভ কিরগিজস্তানের কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে লেবাননে সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার ১৩ দিন ধরে বিশাল বিক্ষোভ হয়। এই বিক্ষোভের মূল কারণ ছিল ব্যাপক সরকারি দুর্নীতি, দেশের অর্থনৈতিক সংকট এবং সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যবস্থা। প্রতিবাদকারীরা সরাসরি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির সরকারকে লক্ষ্য করে স্লোগান দিতে থাকেন। দেশের অর্থনৈতিক মন্দা, দুর্নীতির বিস্তার এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছিল। এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে দেশব্যাপী গণবিক্ষোভের মাধ্যমে। লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেন। তাদের প্রধান দাবি ছিল দুর্নীতি দমন এবং দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল সংস্কার।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে বলিভিয়ায় ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে এবং সামরিক বাহিনীর চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন সেদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস। প্রায় ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর ১০ নভেম্বর, ২০১৯ সালে তিনি তাঁর পদ থেকে ইস্তফা দেন। এই বিক্ষোভের প্রধান কারণ ছিল, ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচন। বিরোধী দল ও আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেন যে, মোরালেস নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করেছেন। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এসে নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন এবং মোরালেসের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হন। যা পরে ব্যাপক গণ আন্দোলনের রূপ নেয়।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন শিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে চলতি বছরের জুলাই মাসে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখান। তার পদত্যাগের দাবি জানায়। কম্বোডিয়ার সঙ্গে ফাঁস হওয়া কথোপকথন এবং সামরিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগের জের ধরে এই বিক্ষোভ হয়। তার দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে এটি ছিল সবচেয়ে বড় সমাবেশ। ১ জুলাই থাইল্যান্ডের আদালত শিনাওয়াত্রাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল। পরে অগাস্ট সামে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
সার্বিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিলোস ভুচেভিচের বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সেদেশের একটি স্টেশন ভবনের ছাদ ধসে পড়ার ঘটনার পর দেশজুড়ে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং শাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ এনে পদত্যাগের দাবি জানায়। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিলোস ভুচেভিচকে এই বছর ২৮ জানুয়ারি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।