নিজস্ব প্রতিনিধি: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাবিভাগের এসএফআই পরিচালিত ছাত্র সংসদ কি ভেঙে গেল তাহলে? সেখানে সংসদের সভানেত্রী-সহ ৩১জন সদস্যের গণইস্তফার ঘটনায় তেমনটাই মনে করা হচ্ছে।
সম্প্রতি এই ৩১ জনের ইস্তফা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সংগঠনের 'ওপরতলা'কে চারপাতার একটি চিঠি দিয়ে তাঁরা তাঁদের ইস্তফার কারণ জানিয়েছেন। যে চিঠির ছত্রে-ছত্রে রয়েছে এসএফআইয়ের 'নারীবাদ বিরোধিতা'র কথা, নারী নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত বা অভিযুক্তদের আড়াল করার অভিযোগ, 'আমলাতান্ত্রিকতা'র সমস্যা আর 'শ্রেণি' বা 'জাত' নিয়ে সেই মান্ধাতার আমলের ধারণা নিয়ে চলার কথা।
বাংলায় টাইপ করা চিঠির প্রথমদিকেই বলা হয়েছে, "বহুদিন ধরে যাদবপুরে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকট। কিন্তু বেশ কয়েকটা দীর্ঘস্থায়ী মিটিংয়ের পরও পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেনি, বরং অবনতি ঘটেছে।"
কী নিয়ে 'অন্তর্দ্বন্দ্ব'?
ইস্তফাকারীরা লিখছেন, "সংগঠন এবং পার্টির বিরুদ্ধে সব থেকে চর্চিত সমালোচনা সম্ভবত জেন্ডার। প্রতিনিয়ত পুরুষতান্ত্রিক মন্তব্য এবং কর্মসূচীর মাধ্যমে সংগঠন এবং পার্টির মনোভাব প্রকাশ পায়। SFI এবং কমিউনিস্ট পার্টির বহু নেতার বিরুদ্ধে sexual harassment’এর অভিযোগ আছে। একটা বামপন্থী সংগঠনের ভেতর থেকে কেন উঠে আসবে এই অভিযোগ, কেন’ই বা সেই অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে না? যেন মহিলাদের ওপর অত্যাচার বা যৌন নিগ্রহের অভিযোগ এক ধরনের ‘ছোটো ঘটনা’।...
জেন্ডারের প্রশ্নে কথা বলতে গিয়েও বারংবার ‘tokenism’ প্র্যাকটিস করে সংগঠন এবং পার্টি। নেতারা এখনও মহিলাদের ‘মা-বোন’ বলে উল্লেখ করে চলেছে, এবং এই সমস্যা বছরের পর বছর চলছে।"
বোঝাই যাচ্ছে, কোনও খুচরো বিষয় নিয়ে স্বার্থের সংঘাত নয়। বরং সংঘাত অনেক গভীরে, যা ভীষণভাবেই নীতি বা আদর্শের প্রশ্নে। বস্তুত এই সমস্যা যে সংগঠনের ভিতর ছিল না এমনটা নয়। কিন্তু বামেদের ৩৪ বছরে তা খুব-একটা সামনে আসেনি। যদিও সংসদীয় বামদল গুলো যে আর শ্রমিক শ্রেণির দখলে নেই, তা রীতমতো মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেদের কব্জায় চলে গিয়েছে, তা নিয়ে তখনও বিতর্ক হয়েছে সিপিএমের মধ্যে। এই চিঠিতেও রয়েছে তার উল্লেখ: "সেই সময় দাঁড়িয়েই অশোক মিত্রর মতো একজন অর্থনীতিবিদ পার্টি ছেড়ে চলে যান, বলেন 'আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট।' গোটা সংগঠন/পার্টি জুড়ে উচ্চবর্ণ নেতৃত্ব। নমঃশূদ্র নেতৃত্বের সংখ্যা অত্যধিক কম, অথচ দেশজুড়ে বহু নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে ভারতের অধিকাংশ শ্রমিক নিম্নবর্ণের। তাহলে কে চালাচ্ছে শ্রমিকের পার্টি? সবর্ণ ব্রাহ্মণ পুরুষরা পরিচালনা করছে এই পার্টির নীতি এবং কৌশল। যথারীতি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্তের আধিপত্য তৈরি হচ্ছে পার্টি এবং সংগঠনে। যতবার এই ব্যক্তি পরিচয়ের প্রশ্ন তোলা হয়, ‘identity politics’,এর যুক্তি দিয়ে বলা হয় শ্রেণী’ই আসল পরিচয়।"
আর 'শ্রেণি'র প্রশ্নে কী বলছেন বিক্ষুব্ধ কমরেডরা?
চিঠিতে ক্ষোভ ফুটে উঠেছে স্পষ্ট:" মানুষের জামাকাপড় দেখে বিচার করা সে কোন শ্রেণির অন্তর্গত, তার চেহারা দেখে তার শ্রেণি চরিত্রের ব্যাখ্যা করা, এর থেকে শ্রেণি অসচেতন ধারণা কী হতে পারে? এই ধারণাগুলো আদতে মধ্যবিত্ত প্রবণতা, যা শেখায় একে-অপরের মধ্যে রেষারেষি করা। মার্কস’এর ব্যাখ্যা করা অর্থনীতির বিন্দুমাত্র চর্চা থাকলেও এই ধারণা তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। যে বামপন্থী সংগঠন/পার্টির শ্রেণি সম্পর্কে কোনও বোঝাপড়া নেই, সেই পার্টি করা সম্ভব কী ভাবে? এই চিঠিতে স্বাক্ষর প্রদান করা এমন অনেকেই আছে যারা ‘inner-party struggle’এর নামে মুখ বন্ধ করে বসেছিল প্রায় দুই থেকে তিন বছর। কমিউনিস্টরা শ্রেণি সংগ্রাম করবার আগে শ্রেণি সংগ্রাম আদতে কি তা নিয়ে চর্চা করে, খেটে খাওয়া মানুষের সভায় প্রাইভেট গাড়ি করে ভাষণ দিতে আসে না। শ্রেণিসংগ্রামের চর্চা থাকলে বৃহৎ বুর্জোয়াদের সাথে হাত মিলিয়ে ৭’টা ‘Special Economic Zone’ও তৈরি করত না তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।"
এছাড়াও রয়েছে সংগঠনের 'উপদল'য়ের সমস্যা ও আমলাতান্ত্রিকতার প্রশ্ন। আর তাই, "শ্রেণি সংগ্রাম জোরালো করতে হলে এই পার্টিকে হয় তার কর্মসূচীর পরিবর্তন করতে হবে, নয় সরে দাঁড়াতে হবে, এবং এই কথা পশ্চিম বাংলার জন্য সব চেয়ে প্রযোজ্য।"
এসএফআইয়ের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় লোকাল কমিটির সম্পাদক ও কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদককে দেওয়া এই চিঠি এখন কার্যত খোলা চিঠি হয়ে সোশাল মিডিয়ায় ঘুরছে। যা শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হিসেবে সিপিএমের ছাত্র সংগঠন তথা গণ সংগঠনের কাছে প্রত্যাশার অতীত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী তথা এসএফআই থেকে বেরিয়ে আসা কর্মী রাজর্ষি দত্তের কথায়, "দেখুন অন্তর্দ্বন্দ্ব আমাদের সময়েও ছিল। আমরাও সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে কর্মসূচী নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু টালবাহানা করে তা পিছিয়ে দেওয়া হয়। জেন্ডার প্রশ্নে বৈষম্যমূলক আচরণ তো আর নতুন কিছু নয় এসএফআইয়ের মধ্যে। কিন্তু সিপিএম এখন ক্ষমতায় না-থাকায় যেভাবে বেরিয়ে আসতে পারছে বিষয়গুলো, আগে তা সম্ভব হত না। এই যা ফারাক।"