স্বাধীনতার ৭৩, কার কাছে কেমন এর স্বাদ, নস্টালজিয়া থেকে রিয়্যালিটি

  • স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে দেশ
  • এবার ৭৩ তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন
  • ২০২২ সালে ভারত ৭৫ তম স্বাধীনতা উদযাপন করবে
  • স্বাধীনতা নিয়ে কী বলছেন সাধারণ মানুষ

debojyoti AN | Published : Aug 15, 2019 4:41 AM IST / Updated: Aug 15 2019, 11:12 AM IST

ঋতম তালুকদার, প্রতিবেদক-

স্বাধীনতা দিবস মানেই যেন আস্ত একটা স্মৃতির শহর। স্কুল জীবনে পরিস্কার করে ধোওয়া ইউনিফর্ম, সুন্দর করে নখ কাটা,ঝকঝকে দাঁত আর পরিপাটি করে কাটা চুলে, কদমছাট ।  প্রত্যেকের ভোরবেলায় উঠে হাত ভরে ফুল তুলে নিয়ে যাওয়া, পতাকা উত্তোলন আর প্যারেড-এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে খাবারের প্যাকেটাও ,ভালবাসার সঙ্গে  পেট ভরানোটাও যে অত্যন্ত জরুরী,সকালবেলা উঠে আমরা সকলে সেটা টের পাই ।  তাই যতই বড় হই না কেন, স্বাধীনতার শিকড়টা যেন সেই লোকানো থাকে ছোটবেলার শহরে।  

আর এই স্মৃতির সরণি বেয়ে আসে কিছু বোধ। যা বয়সের পরিপক্কতার সঙ্গে সঙ্গে এক একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দেয়। সেই কারণে অনেকে আবার ছোটবেলায় ফেলা আসা স্বাধীনতা দিবসের স্মৃতির সঙ্গে জুড়ে দেন তাঁদের বর্তমান অভিজ্ঞতার কাহিনি। আসলে স্বাধীনতা ঠিক কী? এমনই প্রশ্ন নিয়ে এশিয়ানেট নিউজ বাংলা হাজির হয়েছিল কিছু মানুষের সামনে। কী বললেন তাঁরা? জানুন- 
 
 শ্রেষ্ঠা কাঞ্জিলাল
ছাত্রী, ২য় বর্ষ
কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় 

'ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি,স্কুল এই দিনটা ছুটি থাকতো। স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ওইদিন ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না। কিন্তু স্কুল থেকে কলেজ আসার পর যখন বাইরের দুনিয়াটা দেখলাম, বোঝার চেষ্টা করলাম,তখন কোথাও একটা মনে হয় যে স্বাধীনতার এত বছর পরও আমাদের সেই ইনফিউরিটি কমপ্লেক্সটা রয়েই গিয়েছে। এখনও আমাদের সমাজে শক্তি আর সংরক্ষণ-এর অপব্যবহারটা রয়েই গিয়েছে।  
তবু এই দিনটা হয়তো  মনে করিয়ে দেয় যে, পূর্ব-পুরুষরা আমাদের জন্যে কিছু স্বপ্ন দেখেছিলো এবং সেটাকে উৎসর্গ করেছে। তাই আমরা যদি চাই যে আমাদের দেশ আর সমাজ-কে উন্নত করতে,- আমাদের নিজেদেরকেই সেই কাজটা করতে হবে,আর সেই জন্য সবার আগে আমাদের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হতে হবে।'

 তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এই দিনটা অন্য স্বাদের ভালোলাগাতেও ভরে  থাকে- 

লগ্নজিতা চক্রবর্তী
সঙ্গীতশিল্পী 

'আমি পাঠভবন-এ পড়তাম। স্বাধীনতা দিবসে আমি পুরো দিনটাই  বাড়িতেই থাকতাম । মা- বাবা-র সঙ্গে কাটাতাম। বাড়িতে মাংস-ভাত হত।  তবে, ভালোলাগার অন্য আরও একটা কারণ স্বাধীনতার দিবসে আমার মা-বাবার বিবাহ বার্ষিকী’।“    


 
এ রায়চৌধুরী
সায়েন্টিফিক অফিসার, ভাবা রিসার্চ সেন্টার   

১৯৪৭ সালে আমরা  ব্রিটিশ-রাজের থেকে স্বাধীনতা পেয়েছি। তবে সত্যিকারে স্বাধীন হতে পারব, যখন সবাই আমরা দারিদ্র মুক্ত হতে পারব, সুস্বাস্থ্যের অধিকারি হব। আমি মনে করি প্রতিটা মানুষকে তার বিশ্বাসযোগ্যতা রাখা উচিত।একে অপরের সঙ্গে যত্নবান হওয়া উচিত। হিংসা বিভেধ ভুলে সকল মানুষের কর্ম সংস্তান এর মধ্যে দিয়ে এবং পাশাপাশি মেয়েদের সুরক্ষা ও তাদের  বেড়ে ওঠার জন্য ভালো সুযোগ দেওয়ার মধ্যে দিয়েই  আরও সমৃদ্ধ হবে আমাদের  স্বাধীনতা দিবস।“   


 
 দেবনীল পাল
ইতিহাস, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
 
'আমরা স্বাধীনতার এতগুলি বছর  পেরিয়ে এসেছি, কোনও বৈদেশিক শক্তি আমাদের এখন শাসন করে না। কিন্তু দেশের মধ্যেই কিছু শক্তি রয়েছে ,যারা জনগণের মতামত গ্রহণ করে না। মুলত ভারতবর্ষ তৈরি হওয়ার সময় যে বিশ্বাস গুলি ছিল, যে সাধারণ বিষয়সূচী নিয়ে গড়ে উঠেছিল,সেগুলিতে তারা বিশ্বাস রাখে না ,এরকম কেউ কেউ কিন্তু দেশ শাসন করছে,সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সেভাবে পাইনি । তবুও বলা যায়  কিছুটা হলেও যেটা পেয়েছি,সেটা আমাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত করার স্বাধীনতা।কিন্তু সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। আসলে দেশ স্বাধীন হবার প্রথম ১৫-২০ বছর অর্থাৎ ১৯৭০ অবধি আমাদের একটাদিকে নজর ছিল, কিন্তু তারপর থেকে ওটা অন্য বিষয় এর দিকে সরে যায়, ধর্ম-বর্ণ-জাতি এই জিনিস গুলি তখন  গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে । এরই ভিত্তিতে আমরা শ্রেণী বিন্যাসে নেমে পড়ি। বলা যায় এরপর থেকেই সামাজিক আর অর্থনৈতিক  স্বাধীনতা নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামাইনি। তারপর এই বিষয় গুলি নিয়েই রাজনীতি হয়ে চলছে। সেখানে সবাই খেতে পেলো কি পেল না ,সবাই পরতে পারল কি পারল না অথবা আমাদের প্রাথমিক যে চাহিদা গুলি -খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-এর সঙ্গে  শিক্ষা-স্বাস্থ্য, একটু নিরাপত্তা , এগুলি দিক থেকে আমাদের নজরটা পুরোপুরি সরে গিয়েছে। পাশাপাশি বিদেশি কোম্পানির কাছে দিনদিন নির্ভর করছি, যার ফলে আমাদেরই পুঁজি খাটিয়ে তারা লভ্যাংশ নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছে। তবে অবশ্যই আশা রাখবো যে আমরা রাজনৈতিক, সামাজিক আর অর্থনৈতিক  সব দিক থেকেই এগিয়ে যাব, শুধুমাত্র কোনও দিবস উদযাপনের মধ্যে আটকে থাকব না, সার্বিক স্বাধীনতা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।      

 

মেঘ সায়ন্তন ঘোষ 
প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী

' আমি পশ্চিমবঙ্গের প্রথম রুপান্তরকামী মহিলা আইনজীবী ।আমার কাছে স্বাধীনতা বলতে আমাদের রুপান্তরকামী সম্প্রদায় এর সামাজিক ,অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে এখনও অনেক নানা বাধা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। সেই জায়গা থেকে যেদিন পূর্ণ স্বাধীনতা আসবে,সেদিন আমার মনে হয় আমরা পূর্ণ স্বাধীন হতে পারব। একজন আইনজীবী র পাশাপাশি আমি একজন নৃত্যশিল্পি,তাই আমার পায়ের ঘুঙুর-এই আমার মুক্তি।' 

কিছু স্বাধীনতা যেমন কেউ চায় না। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল মা-বাবা থেকে দূরে চলে গিয়ে  একা থাকার স্বাধীনতা। জীবনের সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে,তাই কখনও কি অন্য সুরেও কেউ কেউ চায় এই দিনটা? এই প্রশ্ন নিয়েই আমরা হাজির হয়েছিলাম এক প্রবাসীর কাছে - 

প্রীতম মিত্র
প্রবাসী ভারতীয়, টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট
কগনিজেনট টেকনোলজি সলিউসন্স, নেদারল্যান্ড
  

'স্বাধীনতা দিবসে, সকালে উঠে সাদা-জুতো পরে স্কুল যাওয়া আর বাপুজি-কেক খাওয়া। আর এখন চাকরিতে একদিন ছুটি। এইদিন ,আমরা সবাই দেশাত্মবোধক গান চালাই । যারা গান চালাই,তারা শোনে না কিন্তু। বড় হয়ে ওঠার পর এসব ভালো লাগে না, বরং ওটা একটু ব্লুস অথবা লালনগীতির মত  করে শুনতে যেন মন চায়। ইতিহাসটাও ছোটবেলায় নোট পড়ে পাশ করেছি বলে,সেরকম জ্ঞান নেই।   এক কথায় একটা ছুটির দিন।নিজের দেশে থাকাকালীন শুক্রবার অথবা সোমবার পড়লে লম্বা ছুটি পাওয়া যায়। একটু স্বাধীন লাগে।' 

নীলাঞ্জনা গুপ্ত
অধ্যাপিকা, ইংরাজি সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্য়ালয়

'আমি গত বছর ১৫ অগাস্ট লাদাখ গিয়েছিলাম, গিয়ে দেখলাম যে খুব উৎসাহের সঙ্গে ১৫ অগাস্ট পালন হচ্ছে। সেইসময় আমরা শ্রীনগর হয়েই গিয়েছিলাম,কিন্তু সেখানের অবস্থা সে সময় ভালো ছিল না। কারণ সেই সময়ই ৩৫এ নিয়ে প্রথম কেসটা ওঠে । তখন  ওখানে আমরা থাকাকালীন বনধ চলছিল।  ওখানকার স্থানীয় বন্ধুবান্ধবরা ভেবেছিল, এটা নিছকই বিগত সময়গুলির মত একটা ঘটনা। কিন্তু আমরা তারপর ওই জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে যাই। কিন্তু এখন বর্তমান সময়ে দাড়িয়ে ওই জায়গার এবং আমার চেনা কোনও মানুষজনের  খবর সংবাদ মাধ্যমে বা অন্য কোথাও সেভাবে পাচ্ছি না। ১৫ অগাস্ট  বলতেই আমার এই আগের বছরের অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে।' 

সাহেব হাসান
জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, প্রতিবন্দি বিভাগ  

'আমি ভারতের প্রতিবন্দি বিভাগের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। স্বাধীন ভারতে, আমি সাধারণ মানুষের মত সমান অধিকার পেতে চাই। প্রত্যেকে যেন প্রতেকের দিকে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দেয়। প্রত্যেকটি মানুষ যেন বিভাজনের বাইরে গিয়ে ভারতীয় পতাকার সাথে  সচিন তেন্ডুলকর, হেমা দাস-কে যেভাবে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে, ঠিক সেই ভাবেই আমাদেরকেও যেন  সাধারণ মানুষ  সমান সম্মান এর চোখে দেখে।'   


  
মগনলাল মির্ধা
বই বিক্রেতা, কলেজ স্ট্রিট 

'আজকের ১৫ই আগস্টের সঙ্গে আমাদের অনেক চাওয়া-পাওয়া জড়িয়ে রয়েছে।আজকে হয়তো আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি,কিন্তু সেটা সবক্ষেত্রে পাইনি। আজ ভারতবর্ষে সবচেয়ে বড় প্রশ্নচিহ্ন দেখা যায় সেটা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। যেখানে আমাদের মানুষ হিসেবে একজন ভারতবাসী হিসেবে ভাই-ভাইএর মত বসবাস করা উচিত।আমি আশা রাখবো আগামী দিনে আমাদের এই ভাগাভাগি , ভেদাভেদ মুছে যাবে। আমরা বেকারত্ব মুক্ত ভারত হব,আর শিক্ষা-ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন আগের মত সুসম্পর্কের সঙ্গে তাদের অধিকার দাবি করবে, সার্বিক শান্তি আসবে।'  

বাচ্চু কুণ্ডু
ফুটপাতের ফল বিক্রেতা, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ, শিয়ালদহ

 
'স্বাধীনতা দিবস আমার কাছে খুবই আনন্দের দিন, অনেক মানুষ নিজের রক্ত ঝরিয়ে ব্রিটিশ শাসন থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করেছে । এই দিন আমার দোকান ছুটি থাকে, পরিবারের সাথে সারাদিন কাটাই।,তবে এইদিনটায় আরও খুশী হতাম-দেশ টা আজ যদি তিন ভাগ না হত,তাহলে ভারতবর্ষ আজ পৃথিবীর মধ্যে আরও বেশি শক্তিশালী দেশ হতো।'   

পি কে ওঝা 
ট্য়াক্সি চালক, কলকাতা

'আমার দেশের বাড়ি বিহারে। ওখানে আমার ৪ মেয়ে, ১ ছেলে থাকে। আমার উপার্জনের প্রায় পুরোটাই  পরিবারকে পাঠাই। তাই স্বাধীন হওয়ার পরও আমার মাথায় অর্থনৈতিক চিন্তাটা ঘুরতেই থাকে। কারণ তাদেরকে বিয়ে দিতে অনেক টাকা সঞ্চয় করতে হবে আমাকে। তবে যাইহোক  সেভাবে আমার এই দিনটা নিয়ে আলাদা কিছু বলার নেই- তবে হ্যাঁ স্বাধীনতা দিবস-এ আমি চাই সবাই কুশলমঙ্গল থাকুক।' 

Share this article
click me!