গণবিপ্লবের সৈনিক সন্তোষ রাণা প্রয়াত, রেখে গেলেন এক অমোঘ বিশ্বাসের জীবন

  • প্রয়াত হলেন সন্তোষ রাণা
  • নকশাল আমলে চারু মজুমদারের অন্যতম আস্থা ভাজন ছিলেন তিনি
  • ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় মৃত্যু তাঁর
  • রাজনৈতিক মহলে শোকের ছায়া

Jayita Chandra | Published : Jun 29, 2019 12:20 PM IST / Updated: Jun 29 2019, 07:08 PM IST

স্বপ্ন ছিল সমাজটা বদলে যাবে। বদলে যাবে সেই সব না-খেতে পাওয়া মানুষগুলোর চোখ-মুখ-গ্রাসাচ্ছাদন। পড়াশোনায় তুখড়। পদার্থবিদ্যায় তখন রাজ্যের এক নম্বর কলেজ প্রেসিডেন্সির ছাত্র তিনি। কিন্তু অধিকার লড়াইয়ের মানুষের পদধ্বনি তাঁর মনে যেন নেশা ধরিয়ে দিত। পারেননি নিজের মেধাকে শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘেরাটোপে বেঁধে রাখতে। সন্তোষ রাণা পাড়ি জমিয়েছিলেন না-খেতে পাওয়া মানুষের অধিকার লড়াইয়ে। অবশেষে সেই লড়াই থেমে গেল। কারণ, ৭৬ বছর বয়সে থেমে গেল গণবিপ্লবের এই সৈনিকের জীবন। প্রয়াত হলেন সন্তোষ রাণা। আর ফেলে রেখে গেলেন এক অসামান্য জীবন-কাহিনি। যাকে ভিত্তি করেই হয়তো প্রলেতায়িতদের দল ফের জেগে উঠবে অধিকার লড়াইয়ের আন্দোলনে। 

অধুনা পূর্ব মেদিনীপুরের দারিদ্র পীড়িত ও প্রত্যন্ত গ্রাম গোপীবল্লভপুরে জন্ম হয়েছিল সন্তোষ রাণার। বরাবরই মেধাবী ছাত্র পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করতে ভর্তি হয়েছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। নকশালবাড়ি আন্দোলন তাঁর মনেও দাগ কেটেছিল। জোতদারদের বিরুদ্ধে গরিব মানুষের বিদ্রোহে তিনিও যোগ দিয়েছিলেন। এমএসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে পিএইচডি করতে যোগও দিয়েছিলেন সন্তোষ রাণা। কিন্তু, পিএইচডি অসম্পূর্ণ রেখেই ফিরে যান গোপীবল্লভপুরে। সিপিআইএমএল-এর সদস্য হিসাবে কৃষি বিপ্লব সংগঠিত করতে থাকেন। অত্যাচারী জোতদার মহাজনদের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করেন ডেবরা, গোপীবল্লবভপুর, লোধাশুলি, নয়াগ্রামের মতো জায়গায়।  ১৫ থেকে ১৬ হাজার মানুষকে নিয়ে শুধুমাত্র লাঠি হাতে বন্দুকধারী জোতদার এবং তাদের লাঠিয়াল ও পুলিশের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন সন্তোষ রাণা। কিন্ত পরবর্তীকালে নকশাল নেতা চারু মজুমদারের সঙ্গে মতবিরোধের ফলে সিপিআইএমএল ছেড়ে অন্য একটি অতি বামপন্থী সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। 

১৯৭৭ সালে জেলে বসেই বিধানসভা নির্বাচনে জয় পেয়ে গোপীবল্লভপুরের বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র সমাজটাকে বদলাবেন বলে। যাতে গরিব মানুষ তার অধিকার পায়। এর জন্য কোনও অনুশোচনা তাঁর হয়নি। বরং ভাবতেন পড়াশোনার চৌহদ্দিতে অর্থ আয়ের থেকে ৩০ হাজার মানুষের পদধ্বনি তাঁর কাছে অনেক কাছের এবং সমস্ত কষ্ট দূর করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। সন্তোষ রাণার ফেসবুক ওয়ালে গবেষক সুর্পণা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, 'অ্যাকাডেমিকস ছেড়ে দেওয়ায় তাঁর মনে কোনও অনুশোচনা আছে কি না তা আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, উত্তরে সন্তোষ রাণা জানিয়েছিলেন, ৩০ হাজার মানুষ তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য জোতদারদের দিকে তেড়ে যাচ্ছে, এর থেকে বড় পাওনা আর কিছু হয় না।' 

বেশকিছু দিন ধরেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছিলেন সন্তোষ রাণা। শনিবার সকাল ৬টা নাগাদ দেশপ্রিয় পার্কের একটি নার্সিংহোমে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। বামপন্থায় বিশ্বাসী সন্তোষ রাণা নিজের দেহ ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে দান করে দিয়েছিলেন জীবীতকালে। তাই তাঁর মরদেহ সেখানেই দান করা হয়। বামপন্থাকে এতটাই বিশ্বাস করতেন যে প্রথম স্ত্রী জয়শ্রী রানার সঙ্গে এর জন্য বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। কারণ জয়শ্রী-র মনে সন্তোষ রাণার বামপন্থা ছুঁয়ে যেত না। পরবর্তীকালে অবশ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপিকা দেবী চট্টোপাধ্যায়-কে বিয়ে করেছিলেন সন্তোষ রাণা। বামপন্থা-ই যে সমাজের উত্তোরণের একমাত্র পথ তা তিনি শেষ জীবনকালেও বিশ্বাস করতেন। বলতেন কমিউনিস্ট আন্দোলনই মুক্তির পথ। তবে, এরজন্য সবাইকে লড়তে হবে। নব্বয়ের দশকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভুমিকায় নিজেকে তুলে ধরেছিলেন।  শুরু করেছিলেন সাহিত্যচর্চা। সেই সময় একের পর এক নিবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে তাঁর লেখা বই 'রাজনীতি এক জীবন' ২০১৮ সালে আনন্দ পুরষ্কার-ও পেয়েছিল। 

আসলে মানুষের কথা ভাবা, মানুষের জন্য নিজেকে উজার করে দেওয়া এই মানুষটি এক অসামান্য লড়াই লড়ে গিয়েছেন আজীবনকাল। এমন মানুষের কানে মানুষের পদধ্বনি প্রতিভাত হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই সন্তোষ রাণা জীবনকথার কথকতা নয়, হয়তো একটা দর্শন হয়ে বেঁচে থাকবেন গরিব-না-খেতে পাওয়া মানুষদের ইতিহাসের সঙ্গে। 

Share this article
click me!