শুধু কেক নয়, শীতের কলকাতার মহার্ঘ নলেন গুড় আর জয়নগরের মোয়া

  • ঘর-বাড়ি বিপ্লবে দেদার কাটা পড়েছে খেজুর গাছ 
  •  ধিধিধিকি আঁচের আদর্শ জ্বালানি খেজুর গাছের গুঁড়ি 
  • তাই নগদ টাকার লোভে খেজুর গাছ বেঁচে দিচ্ছেন মালিক 
  •  শিউলিরাই পারেন শক্ত কঠিন খেজুর গাছের সার্জারি করতে 
     


তপন মল্লিকঃ- শীতের দিন যতই কেক পেস্ট্রিতে ভরে উঠুক না কেন, নতুন গুড় কিংবা জয়নগরের মোয়া ছাড়া পউষ-মাঘের আগমন থেকে বিদায় কোনও পর্বই ঠিক অনুভব করা যায় না। আমরা এখন পুরোপুরি আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছি ঠিকই তবু দু-একটি ক্ষেত্রে আমরা এখনও ফিরে যাই আমাদের চিরন্তন ঐতিহ্যের কাছে। এটা ঠিক যে কলকাতা বা শহরতলিতে খেজুরগাছ কমেছে। ঘর-বাড়ি-ইমারতের বিপ্লবে দেদার কাটা পড়েছে খেজুর গাছ। কারণ সেই বিপ্লবে লড়ি লড়ি ইটের জোগান দিতে হয়। অন্যদিকে নির্বিচারে গজিয়ে ওঠা বেআইনি ইট ভাটায় ধিধিধিকি আঁচের আদর্শ জ্বালানি হল খেজুর গাছের গুঁড়ি। তাই খেজুর গাছের কদর বাড়ায় নগদ টাকার লোভে গাছের মালিক রাতারাতি খেজুর গাছ বেঁচে দিয়েছেন।

অন্যদিকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন রসের জন্য খেজুর গাছ কাটা দক্ষ শিউলিরা। একমাত্র ওই শিউলিরাই পারেন শক্ত কঠিন খেজুর গাছের সার্জারি করতে। শুধু তো ছ্যান দিয়ে গাছের আগা ছেঁচে, চিকন কঞ্চি ফেঁড়ে, নল পুতে দিলেই হল না। বালিকাচায় ধার তুলে ছ্যানকে জুতসই করা থেকে নলের মুখে লাগসই করে মেটে হাঁড়ি বাধা কী যে সে কথা।কাঁচির পোচে গাছের গোড়া কাটলেই হল না, অনেক সোহাগ দিয়ে শক্ত গাছের গা নরম করতে হয়। তারপর ডাহুক পাখির ঠোঁটের মতো বাঁশের নলি গাছের গায়ে গেঁথে দেওয়াটা তো একতা শিল্প সৃষ্টির সমান। এরপর আছে হাড় কাঁপানো শীতের কুয়াসাচ্ছন্ন ভোরে সেই হাঁড়ি নামিয়ে আনা।  

Latest Videos

 

 

জিরেনের পর প্রথম দিনের রস ফোটালে হয় তাতা রস। সেই রস আরও ঘন হলে হয় নলেন। তারপর ধাপে ধাপে ঝোলা, তারপর পাটালি- প্রতিটি ধাপেই দরকার হয়য় শিল্পীর পরম যত্ন। গুড় জ্বালের সময় যত আদর পায় ততই তার স্বাদ-গন্ধ আলাদা আলাদা হয়। খেজুর গাছের রস আর সেই রস জ্বাল দেওয়ার মাহাত্ম আমরা প্রায় সকলেই পড়েছি এবং দেখেছি মোতালেফ মিঞ্চা আর ফুলবানুর গল্পে। খেজুর রস আর গুড়ের মাতোয়ারা স্বাদ-গন্ধময় আখ্যান নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্প মারফত বাংলা সাহিত্য থেকে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘সওদাগর’ ছবির হাত ধরে পৌঁছে গিয়েছে বলিউডে।  

মানব সভ্যতার সৌজন্যে আবহাওয়া অনেকটাই বদলে গিয়েছে। তা স্বত্বেও শীতকাল নিয়ম মেনেই আসে যায়। রসে ভরা হাড়ি নামে খেজুর গাছ থেকে। শীতের রসনাপূর্তি থেকে তাই এখনও বাদ পড়েনি নলেন গুড় আর জয়নগরের মোয়া। রদবদল যেমনটাই হোক না কেন কার্তিকের মাঝবরাবর হিমেল হাওয়া এসে শীতের জানান দেয়। আর সে যে দরজায় কড়া নাড়ছে তা বোঝা যায় উত্তর থেকে দক্ষিণ শহরতলি থেকে নলেন গুড়ের নাগর এসে কলকাতায় ভিড় জমাতে শুরু করলে।

 

শুধুমাত্র শীতের সময়েই কলকাতার বাজারগুলি্র আশপাশে নাগর বা নলেন গুড়ের হাড়ি নিয়ে নতুন নতুন দোকান বসে। বসিরহাট-টাকির পাটালিও মেলে ওই সব দোকানে। টাকির পাটালিকে স্থানীয় ভাষায় বলে ভার্লি। নতুন গুড়ের গন্ধে রমরম করে বারুইপুর থেকে বেলঘড়িয়া। খেজুর রস বা নতুন গুড়ের হাত ধরে আসে জয়নগরের মোয়া। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর নামটি যে মোয়ার গায়ে জড়িয়ে আছে, সে কেবলমাত্র ওই এলাকাটুকুতেই আটকে নেই, ছড়িয়ে আছে বহড়ু, মথুরাপুর, মজিলপুর, মন্দিরবাজার, দক্ষিণ বারাসাত-সমেত গোটা জেলার অর্ধেক অঞ্চলজুড়ে।  


নলেনগুড়ের মতো ভাবনার কথা জয়নগরের মোয়া নিয়েও। কেবল যে খেজুর গাছ লুপ্ত হয়েছে তা তো নয়, বেশ কয়েক বছর ধরে কনকচূড় ধান উৎপাদনেও নিরুৎসাহী হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। চাষাবাদের ধরণধারণ বদলে এখন সারা বছরই আবাদ চলে। তবে সারা বছর যে সব ধানের কদর নেই বছরে মাত্র একবার দরকার পরে সেই ধানের চাষে এখন আর কেউ উৎসাহী নয়। আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার কয়েকটি জায়গায় বছরে একবার হলেও উৎসাহের সঙ্গেই কনকচূড় ধান হত। এখন শুধুমাত্র জয়নগরের মোয়ার জন্য বেশি লাভ পান না বলে সেই চাষে আগ্রহী নন। 


আসলে সংকট তো আর নির্দিষ্ট কোনও উৎপাদন ঘিরে নয়, সার্বিক। একটা জাতির রসনায় কি শুধু তার ইচ্ছে বা পছন্দটুকুই জড়িত থাকে? ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির বিবর্তনও নানাভাবে জড়িয়ে পড়ে। সময়ের সঙ্গে ইচ্ছে, পছন্দ, রুচি বদলাতে থাকে, বদলেছেও। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা ঐতিহ্যকে আকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করি, তা নিয়ে বিলাসিতা করি। নলেন গুড় আর জয়নগরের মোয়া শীতের কলকাতার সেই মহার্ঘ- যা না থাকলে শীতের মাহাত্ম ঠিকঠাক অনুভব করা যায় না। তাই নামী দামী কেকসম্ভারের পাশে রসনা তৃপ্তিতে হাজির হয়ে যায় নলেন গুড় আর জয়নগরের মোয়া।  

Share this article
click me!

Latest Videos

Suvendu Adhikari Live : নবান্নের সামনে সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের ধর্না অবস্থান মঞ্চে শুভেন্দু
শীতের রাতে যমুনার আতঙ্ক! একের পর এক জঙ্গল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বাঘিনী | Bandwan Tiger News
নওশাদ সিদ্দিকীকে জঙ্গি আখ্যা Saokat Molla-র, পাল্টা বড় পদক্ষেপ Naushad Siddiqui-র
'মমতা পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি রোহিঙ্গা ঢুকিয়েছে', বিস্ফোরক মন্তব্য Suvendu Adhikari-র
'কেন্দ্র যদি একটু দয়া দেখায় তাহলে হুগলিতেও মেট্রো চলবে', আশাবাদী Rachana Banerjee