এক নামবিহীন বইয়ের কবিতার কথা-- সমালোচনায় ধীমান ব্রহ্মচারী

 কবিতার কথা যখন আসে তখন এমন অনেক কিছুই আছে যা খুব সহজে মনে আসে না। এর কারণ প্রসঙ্গে বলব, বইটার উৎসর্গ— ‘যে কবিতার এখনো ভোরের মুখ দ্যাখেনি’।

Asianet News Bangla | Published : Jun 20, 2021 4:28 AM IST / Updated: Jun 20 2021, 10:04 AM IST

বইটির নাম নেই, কবির নাম আছে। কবি শুভাশীষ দত্ত। কবি তাঁর নিজের বই-এর নামকরণ না-করতে পারার এক অভিনব ইঙ্গিত পাঠককে জানান দেয়। কবিতার কথা যখন আসে তখন এমন অনেক কিছুই আছে যা খুব সহজে মনে আসে না। এর কারণ প্রসঙ্গে বলব, বইটার উৎসর্গ— ‘যে কবিতার এখনো ভোরের মুখ দ্যাখেনি’। 

কি অদ্ভুত একটা উৎসর্গ পত্র! সাধারণত বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে এই ধরনের উৎসর্গ পত্র যে একদমই হয় না, তা ঠিক নয়। তবে যদি বিরলের কোনো লিস্ট করি, তাতে এই উৎসর্গ অবলীলাক্রমে থেকে যেতেই পারে। অন্তত আমার এমনটাই মনে হয়। “অনুষ্টুপ” থেকে প্রকাশিত সমীর সেনগুপ্ত-এর একটা বই নাম, ‘রবীন্দ্রনাথের গান দীপের মতো গানের স্রোতে’। সেই বইয়ের একটা প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি বলছেন :  ‘যাকে প্রবন্ধ বলি এই লেখাটা ঠিক সেই গোত্রের নয়। প্রবন্ধে আমার উদ্দিষ্ট পাঠক তাঁরাই, যাঁদের স্বমতে আনবার জন্যে আমাকে না না যুক্তি খুঁজে খুঁজে সাজাতে হবে। আর এখানে আমি খুঁজছি সেই পাঠককে যিনি মূলত আমার সঙ্গে একমত, আমার মতো মতো করেই রবীন্দ্রনাথের গান শোনেন। বহুকাল ধরেই গান শুনতে শুনতে মাথার ভিতরে নানা ভাবনা সঞ্চিত হয়ে উঠেছে— কিন্তু পুরো অবয়ব পায়নি, অর্ধগঠিত হয়ে আছে মাত্র।...’

【রবীন্দ্রনাথের গান দীপের মতো গানের স্রোতে / অনুষ্টুপ】
 আমার বলার উদ্দেশ্যও অনেকটা এক। আসলে কবিতার মতো কবিতাকে দেখা বা পড়া এটা যে সবসময় সার্থক হবে, তেমন কোনো কথা নেই। কবিতা অনেকটা সময়ের দাবি রাখে। কখনো কখনো সে-দাবি অপেক্ষা করে থাকে দিন থেকে মাস পেরিয়ে বছরের অপেক্ষায়।

ছোট্ট একটা বই। এখানে প্রায় উনচল্লিশটা কবিতা নিয়ে সংকলন হয়েছে বইটা। প্রথম কবিতা যেভাবে শুরু হয়েছে—
‘একবিন্দু শহরকেও শুকনো রাখেনি মেঘ। আমরা সেই মেঘের মানুষ, প্রতি/
মুহূর্তের বিশ্রী ব্যস্ততায় ভিজিয়ে তুলি ক্লান্তির কাল। পেতে নেই ভাত, মুহূর্তে/
ভ’রে ওঠে ফুটপাতের সস্তা ফাস্টফুডে। বিকেল হলে পকেট হাৎরাই; /
দু’তিনটে ঘাস উঠে আসার মতো উঠে আসে চার-পাঁচটা খুচরো অবশেষ;... /

বইটার প্রথম কবিতা ‘শহরজীবন’। প্রায় গদ্যের রীতিতে কবিতাটা প্রকাশ পেয়েছে। অনেক সময় কবিতা গদ্যের রীতি মেনে চলে, নিজের খেয়ালে। কবি এখানে এই কাজটাই করেছেন। কেন-না, এই কবিতার মধ্যে দিয়েই কবি নিজের যাওয়ার রাস্তা প্রস্তুত করেছেন।

 যে-কোনও কবি বা শিল্পীর কাছে শহুরে জীবনের কদর অনেকটা ব্যক্তিগত স্তর। কেন-না, এই শহরের সামাজিক  ও অর্থনৈতিক সামঞ্জস্য একটা বিরাট ব্যাপার। আর কবিতার মধ্যে দিয়েই কিন্তু তিনি বলছেন, কোনও কালে তাঁর নিজের সঙ্গে লেগে থাকা। তারজন্যেই তিনি এই শহরের কথা অকপটে বলতে পারেন। নির্দ্বিধায় বলেন, এই শহরকে শুকনো রাখেনি মেঘ। তবে এখানে ‘রাখেনি’ ‘মেঘ’ শব্দ দু’টি কিন্তু অনেকটা আগাম সতর্কতাবার্তা; আর, এই কথার পাশাপাশি তিনি, মেঘের একটা পূর্ণাঙ্গ কাজের প্রক্রিয়াকরণ তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ এমন বৃষ্টি হয়েছে যেন সব কিছু ধুয়ে সাপ হয়ে গেছে। তাই বৃষ্টির আশু সম্ভাবনার কথা তিনি বলেছেন আগেই। এর যদিও এখানে যেন নিজেই একটা স্টেটমেন্ট দিচ্ছেন। আর তার ফলে আমাদের সামগ্রিক একটা শহরের জলছবির কথা মনেপড়ে। ‘কবিতার লাইনে আরো একটা শব্দ, ‘শুকনো’ যা থেকেই শহরের ভিজে যাওয়ার ছবি খুঁজে পান। পেটে খাবার না-থাকা মানুষও শেষে বেঁচে যেতে পারে। এই চেনা দৃশ্য শুধুমাত্র আমরা যাঁরা শহর ঘুরতে ঘুরতে প্রতিদিনের কাজ সেরে ফেলি। ঠিক তেমনই কলকাতা নামক শহরের বুকে গজিয়ে ওঠে কোনো স্বপ্ন, অথবা বাস্তবতা; নয়তো যেভাবে ‘সুররিয়ালিসম’কে অদ্ভুতভাবে আমরা প্রতিস্থাপন করে থাকি। একটা প্যারালাল জগৎ যেন তাঁর পেছনে পেছনে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কবি এইভাবেই কোথাও যেন মহাপৃথিবী হয়ে গেছে আমাদের জীবনানন্দের মতোই।

এই বইয়ের আরো দু’টো কবিতা এক ‘অনন্ত বাসুকীদেব’ ও ‘একটি সিসিক্যামেরার জবানী’। দু’টো কবিতায় একটা বাস্তব থেকে পরাবাস্তব বা Surrealism-এর তত্ত্বকে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের মতো কবিতা প্রেমী পাঠকদের কাছে।

প্রথম কবিতার একটা লাইনে লিখছেন : ‘অন্ধ স্যাঁতসেঁতে গর্ভগৃহে তিনি এতকাল একটা টিমটিমে প্রদীপের সামনে মানুষজনের অত্যাচার সহ্য করেছিলেন—’ এই কবিতার মধ্যে দিয়েই কিন্তু একটা ঘটনার প্রবাহ লক্ষ্য করা যায়। এই বাসুকীদেবই যেন এখানে একটা ‘সিম্বল’ বা কোথাও Symbol-কে উপস্থাপন করেছেন; এবং এই কথার মধ্যে দিয়েই উঠে আসে তাঁর ধর্মের প্রতিশ্রুতি। এই ধর্মকে তিনি কখনো সময় অবমাননা করতে পারেন না। আমরা যাদের গ্রামের ভাষায় বলি, ‘কিরা’ অর্থাৎ দিব্যি দিয়েছে। এই অস্থির সময়েই একই কবিতার কথা আমাদের বার বার স্মরণ করে দেয়। এই দুর্নিবার গতি মাঝে মাঝে আমাদের করে নেয় গোটা একটা আস্ত ভারতবর্ষ।

আবার, দ্বিতীয় কবিতায় লেখেন :
...‘উপরওয়ালার আমাকে বসিয়েছেন
শহরের পাপমোচন করার দায়ে;
কিন্তু আমি কোথাও কোনো পাপ দেখতে পাচ্ছি না!...’

এখানে দেখতে পাই কবি নিজেই এক ব্রহ্ম প্রেরিত দূত। তিনি নিজেই কিন্তু নিজের কল্পনাকে চালনা করেন। আমাদের বর্তমান শহরের ইতিকথা দেখেন তিনি। অর্ধশতাধিক ধরে বয়ে আশা বিশ্বাস তা সে জোট ছোটোই হোক-না কেন, তাতে আছে মলিনতা। তাই একান্ত বিশ্বাসী ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে তিনি নিজেকেই হঠাৎ সু-নাগরিকদের বিপরীতে বসিয়েছেন। তার উদাহরণ, এই কবিতার একটা লাইনে ‘হে সুসভ্য নাগরিক’ বলে সম্বোধন করেছেন।

 কবিতার মধ্যে দিয়েই কবি তাঁর পারলৌকিক ও পরাবস্তবতার একটা যোগসূত্র করার চেষ্টা করেছেন। প্রগতিবাদের দিকেই থেকেছে যেন তাঁর অভিমুখ। একে একে এভাবেই কবিতার দীপ তৈরি হয় সলতে পাকাতে পাকাতে। সেখানে থাকে বহ্নিশিখা। অবিরাম যেন তার দ্যুতির দ্যোতনা তৈরি করে মস্তিষ্ক। যেখান থেকে একে অপরের স্নায়ুর বন্ধন যোগ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে স্থির দৃশ্যের সমান্তরালে।
 আমরা শুধুমাত্র সেখানে আসতে করে ঢুকে পরি। তারপর কুল পাওয়ার চেষ্টা করি। সেখানে থাকে বিষাদ ঢেউয়ের স্রোত। এই স্রোতের খেলা চলে অবিরাম। আমাদের পারে থেকে ছোট ছোট ডিঙ্গা। রাতে অন্ধকারে আমরা ডিঙা ভাসিয়ে চলে যেতে থাকি, যেটা আমাদের কবি তাঁর ‘গালিব’ কবিতায় তখন লেখেন : 
‘জানালা কাচে
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির দাগ লেগে আছে;
মনেহয় শায়েরী লিখছেন মির্জা গালিব।
কিন্তু যেহেতু আমি উর্দু পড়তে পারি না
তাই সযত্নে মুছে দিই না বুঝে।’
   
আমরা একটা স্থির চিত্র দেখি। সেখানে একটা হালকা আলো ভেসে আসে। আমাদের চোখে সবটুকু দেখে বিশ্বাস করে নিতে চাই, এই ভেবে যে এই সেই বই যেখানে একটি নাম দিলেও তো দেওয়া যেতেই পারত।


 
লেখক পরিচিতি : ধীমান ব্রহ্মচারী’র জন্ম ১৯৮৭ সালে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জে বেড়ে ওঠা। তারপর কলকাতায় আসা কলেজ জীবনে। বাংলায় স্নাতকোত্তর। লেখালিখি শুরু ২০০৫ সাল থেকে। প্রথম সম্পাদিত পত্রিকা “কবিতা বুলেটিন” ২০০৯ সাল থেকে। পরে ব্যক্তিগত ইচ্ছায় “ম্যানিউসক্রিপ্ট” নামে লিটিল ম্যাগাজিনের সম্পাদনা। পরবর্তীতে “এবং অধ্যায়” নামে একটি পত্রিকা ও প্রকাশনার চালাচ্ছেন। মূলত কবিতা লেখার পাশাপাশি প্রবন্ধ, নিবন্ধ, গল্প সবই লিখেছেন। তবে সবচেয়ে ভালোবাসেন স্মৃতিকথা লিখতে। বর্তমানে চুঁচুড়ায় থাকেন। দীর্ঘদিন এই বাংলার এক প্রথম শ্রেণির পত্রিকা গোষ্ঠীতে চাকরি করেছেন। বর্তমানে চাকরি জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য সরে এসে প্রকাশনা ও লেখালিখি নিয়ে ব্যস্ত থাকছেন।

সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময়  মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।

Share this article
click me!