সংক্ষিপ্ত
চর্যার কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী। কেউ পূর্ববঙ্গ, কেউ উত্তরবঙ্গ আবার কেউ-বা অধিবাসী। অনেকে বিহার, ওড়িশা, অসম বা কামরূপের বাসিন্দা ছিলেন। এরা ব্রাক্ষ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, বণিক এমনকি অন্তজ শ্রেণি থেকেও এসেছিলেন।
চর্যাপদ নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম রসাত্বক অঙ্গন। চর্যাপদের সঙ্গে বাঙালির প্রথম পরিচয় সূত্রপাত বাঙালির যৌবনের বন্দরে। তারপর যুগে যুগে চর্যাপদের সম্পর্কে আগ্রহের প্রসঙ্গে উঠে এসেছে কৌতুহলী তথ্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চর্যাপদের কবি বা সিদ্ধাচার্যগণ মূলত বৌদ্ধ সহজনানী ও ব্রজনানী সম্প্রদায় ছিলেন। তিব্বতী ও ভারতীয় কিংবদন্তীতে এরাই “চৌরাশি সিদ্ধা” নামে পরিচিত। তবে এই ৮৪জন সিদ্ধাচার্য আসলে কারা ছিলেন সেই বিষয়ে সঠিক তথ্য আজও ধোঁয়াশা।
চর্যার কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী। কেউ পূর্ববঙ্গ, কেউ উত্তরবঙ্গ আবার কেউ-বা অধিবাসী। অনেকে বিহার, ওড়িশা, অসম বা কামরূপের বাসিন্দা ছিলেন। এরা ব্রাক্ষ্মণ, কায়স্থ, ক্ষত্রিয়, বণিক এমনকি অন্তজ শ্রেণি থেকেও এসেছিলেন। কেউ কেউ রাজবংশজাত ছিলেন, তবে এঁরা পূর্বাশ্রমের পিতৃপ্রদত্ত নাম ত্যাগ করেছিলেন বলে এঁদের জাতি স্থির করা যায় না। এঁরা হিন্দুধর্মের সনাতন প্রথা ও বেদের বিরোধিতা করতেন। এমনকি, আধুনিক গবেষকদের মতে অনেকে সাধনার নামে গোপনে যৌনাচার করতেন।
আবিষ্কৃত পুঁথিতে পঞ্চাশটি চর্যায় মোট চব্বিশজন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয় যায়। এক্ষেত্রে আশ্চর্যভাবে জৈনধর্মের চব্বিশজন তীর্থঙ্করের নামের কথাও মনে পড়ে গেল। প্রথম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মতো লুই পা ছিলেন গবেষকদের মতে আদি সিদ্ধাচার্য। বহুল জনপ্রিয় সিদ্ধাচার্য হলেন কুক্কুরী, বিরসা, কাহ্ন ইত্যাদি। ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতী অনুবাদ অনুসারে মনে করেন, প্রত্যেকটি ছদ্মনাম ও ভনিতার শেষে তারা পা কথাটি সম্ভববাচক অর্থে ব্যবহার করতেন।
লুই পা : সম্ভবত লুই পা ছিলেন চর্যাপথের পথিকৃৎ। চর্যাপদের ১৩ ও ২৯ নম্বর পদদু’টি তাঁর রচিত। তিনি ছিলেন সিংহলদ্বীপের এক রাজার দ্বিতীয় সন্তান। “চতুরাশিতিসিদ্ধ” প্রভৃতি গ্রন্থের মতে, লুই পাদের পিতা তাঁকে রাজ্য-শাসনের দায়িত্ব দিতে চাইলেও তিনি বোধিলাভের উদ্দেশ্যে নিজের রাজ্য ছেড়ে বুদ্ধগয়ায় চলে আসেন। মগধে একজন ডাকিনী তাকে বোধিলাভের জন্য রাজরক্তের অভিমান ভুলে যাওয়ার উপদেশ দিতে তিনি বারো বছর শুধুমাত্র নিজের রাজ্য ছেড়ে বুদ্ধগয়ায় চলে আসেন। এই কারণে তিনি “মৎস্যোন্মাদ” নামে পরিচিত হন। মগধের রাজা ইন্দ্রপাল ও তাঁর ব্রাক্ষ্মণমন্ত্রী দারিক পা ও দেজি পা নামে দুইজন তাঁর শিষ্যতে পরিণত হন। তাঞ্জুর তালিকায় তাঁর নামে যে-গ্রন্থগুলির উল্লেখ পাওয়া যায়, তার সবগুলি বৌদ্ধদর্শনসংক্রান্ত। “দোঁহাকোষ” ও “গীতিকা” বাদে তিনি লিখেছেন :
১) ভগবদভিসময়
২) অভিসময়বিভঙ্গ
৩) বুদ্ধোদয়
৪) বজ্রতত্বসাধন
লুই পা-র রচিত দু’টি গান হল :
১) কা আ তরুবর পঞ্চ বি ভাল
২) ভাব ন হোই অভাব ন জাই
বৌদ্ধধর্মের গূঢ় অর্থ সাংকেতিক রূপের আশ্রয়ে ব্যাখার উদ্দেশ্যেই তাঁরা পদগুলি রচনা করেছেন। বঙ্গে সাধন সংগীত শাখাটির সূত্রপাত হয়েছিল এই চর্যাপদ থেকেই। সে-বিবেচনায় একে ধর্মগ্রন্থজাতীয় রচনায় আখ্যায়িত করা যেতেই পারে।
কাহ্ন পা : চর্যার পুঁথিতে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্ন পা। তিনি কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণপাদ ও কৃষ্ণবজ্র নামেও পরিচিত। পুঁথিতে তাঁর রচিত মোট এগারোটি পদ পাওয়া যায়। ইনি ছিলেন ওড়িশি ব্রাক্ষণ। মাসিক জলন্ধরী পাদের শিষ্য ছিলেন তিনি। তিনি সোম্পুর মহাবিহারে সাধনা করতেন। এছাড়াও ‘হে ব্রজ’, ‘সমান্তক’ প্রভৃতি তন্ত্রসাধনার ওপর ৭০টি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৩ ও ১৮ নং পদে তার বিবাহের সংবাদ মেলে।
কুক্কুরী পা : চর্যাপদের আদিকবি লুই পাদের শিষ্যা ছিলেন কুক্কুরী পা। গবেষকদের মতে তিনিই একমাত্র মহিলা কবি। তাঁর শিষ্যরা ছিলেন ডোম্বী পা ও বিরু পা। রাহুল সংকীর্তায়নের মতে, কুক্কুরী পা লুম্বিনী নামে এক শিষ্যার কাছে মহামুদ্রাসিদ্ধী লাভ করেন। এই সাধিকা পূর্বে কুক্কুরী ছিলেন, তাই তিনি “কুক্কুরী পা” নামগ্রহণ করেন। অন্যদিকে পণ্ডিত তারানাথের মতে, এই কবির সাথে কুক্কুরী সবসময় থাকত, তাই তাঁর নাম হয়েছিল “কুক্কুরী পা”।
অন্যদিকে ডক্টর সুকুমার সেনের মতে কুক্কুরী পাদের ভাষার সঙ্গে নারীদের ভাষার অনেক মিল আছে, তাই তিনি নারীও হতে পারেন। তাঁর চর্যাগুলি হল :
১) দুহি দুহি পীড়া ধরন জাই
২) হউ নিরাসী খমন ভতারী
৩) কুলিশ-ভর-নিদ-বি-আপিল
তথ্যসুত্র : ১) চর্যাগীতিকা, মহম্মদ আব্দুল হাই ও আনোয়ার সম্পাদিত
২) আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়
লেখক পরিচিতি : নন্দিতা দাস বসু মূলত গৃহবধু হলেও সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে লেখালেখি চালিয়ে যান। তাঁর প্রিয় বিষয় প্রবন্ধ রচনা। বর্তমানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লিটিল ম্যাগাজিনে লেখালেখি করেন।
সংকলনা- জয় ভদ্র, "হরপ্পা", "হাজার শতাব্দীর রূপকথা অথবা রাজনৈতিক বিষণ্ণতা", "ইডিকেস"-এর মতো বইয়ের লেখক তিনি, নয়ের দশকের শেষ লগ্ন থেকে লেখালেখি শুরু। "হরপ্পা" অনূদিত হয়েছে হিন্দি ভাষায়। এছাড়াও তার ছোটগল্পগুলো একসময় হিন্দি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ছিলেন এক বিশেষ পত্রিকার কার্যকরী সম্পাদক। একটা সময় মূলত সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে চালিয়ে গিয়েছিলেন সাহিত্যকর্ম। এই মুহূর্তে পুরোপুরি সাহিত্যেই মনোনিবেশ করেছেন। গল্প, উপন্যাস যেমন তাঁর অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র তেমনি পুস্তক সমালোচনা এবং নাট্য-সমালোচক হিসাবেও সমাদৃত হয়েছেন।