তপন মল্লিক
বাইডেনের কাছে ভোটে হেরেছেন, ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন, হোয়াইট হাউস না ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন শেষমেশ ক্যাপিটল হিলের ঘটনার পর কোনঠাসা ট্রাম্পের ব্যাপারে তার সমর্থকরাই প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। অনেক প্রশ্নের মধ্যে এই প্রশ্নও উঠেছিল, তাহলে কি ২০ জানুয়ারি অনুষ্ঠানেও উপস্থিত থাকবেন ট্রাম্প? সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি টুইটে লিখেছিলেন, ‘যাঁরা প্রশ্ন করছেন, তাঁদের জানিয়ে রাখি আগামী ২০ জানুয়ারির অনুষ্ঠানে যাচ্ছি না’। ট্রাম্পের আচরণ নিয়ে নতুন করে বিশেষ কিছু বলার নেই যদিও তবে মার্কিন মুলুকে এ নিয়ে বেশ হইচই হয়েছে। কারণ নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রেসিডেন্টের উপস্থিত থাকাটা আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী একটি রীতি। ট্রাম্প সেই রীতি অমান্য করতে না চাওয়ায় প্রায় সবাই নানা সমালোচনা করেছেন। কিন্তু ট্রাম্পই কি প্রথম এই রীতি অমান্য করতে চেয়েছেন বা করবেন? না তা মোটেও নয়। তাঁর আগে অন্তত পাঁচজন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট সেই ঐতিহ্য অমান্য করেছেন। উত্তরসূরির শপথ অনুষ্ঠানে তাঁরা উপস্থিত থাকেননি। উত্তরসূরিকে হোয়াইট হাউসে সশরীরে উপস্থিত থেকে শুভেচ্ছা জানাননি।
আমেরিকার ইতিহাস অনুসারে থমাস জেফারসন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন ১৮০১ সালে। ইতিহাস বলে স্বাধীনতা লাভের পর সে বছর প্রথম আমেরিকায় অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী নির্বাচনে জিতেছিলেন। থমাস জেফারসন জন অ্যাডামসকে হারিয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন থমাস জেফারসন নতুন প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেবেন সেদিন খুব ভোরবেলায় প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস হোয়াইট হাউস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য থমাস জেফারসনও তাঁকে শপথ অনুষ্ঠানে থাকার অনুরোধ করেননি। ধরে নেওয়া যায় দুটি ভিন্ন দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব আর তা থেকে যে কোনও রকম সংঘাত ঠেকাতেই জন অ্যাডামস এমন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
জন অ্যাডামসের ছেলে জন কুইন্সি অ্যাডামসও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আমেরিকার ইতিহাসের তিনি ছিলেন ষষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট। ঘটনাচক্রে জন কুইন্সি অ্যাডামসও তাঁর বাবার মতো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটান। ১৮২৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে জন কুইন্সি অ্যাডামসের মেয়াদ শেষ হয়। সেবার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতেছিলেন অ্যান্ড্রু জ্যাকসন। কিন্তু নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউসে আসার আমন্ত্রণ জানাননি জন কুইন্সি অ্যাডামস। জ্যাকসনও এ বিষয়টিকে মাথায় রেখেছিলেন, তিনিও তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জন কুইন্সি অ্যাডামসকে আমন্ত্রণ জানাননি। ফলে শপথ অনুষ্ঠানে আর বিদায়ী প্রেসিডেন্টের উপস্থিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
১৮৩৭ থেকে ১৮৪১ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন মার্টিন। তিনি ছিলেন আমেরিকার অষ্টম প্রেসিডেন্ট। তিনি নির্বাচনে উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। যতদূর জানা যায় মার্টিনও উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেননি। যদিও তার কারণ বিস্তারিতভাবে জানা যায় না। তবে সেই সময়ে আমেরিকা থেকে প্রকাশিত কিছু পত্রপত্রিকায় ওই শপথ অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, মার্টিন ফন ব্যুঁরের ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড মেন্টর জনসন ওই শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট মার্টিনের দেখা মেলেনি।
১৮৬৯ সালে নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন উলিসিস এস গ্রান্ট। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ছিলেন অ্যান্ড্রু জনসন। তাঁদের সম্পর্ক এতটাই খারাপ ছিল যে জনসনের সঙ্গে একই গাড়িতে উঠতে রাজি হননি গ্রান্ট। শেষে বাধ্য হয়ে জনসনকে ফিরে আসতে হয়। হোয়াইট হাউসের শেষ দিনে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে আর তাঁর থাকা হয়নি। বরং দফতরের পুরনো নানা কাজেই তার শেষ দিনটি কেটেছিল। যদিও জনসন ও গ্রান্টের খারাপ সম্পর্কের ছোট্ট একটি ইতিহাস আছে। জনসন তাঁর যুদ্ধ বা সামরিক বিষয়ক মন্ত্রী এডউইন স্ট্যানটনকে সরিয়ে গ্রান্টকে বসাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস এতে বাদ সাধে। ফলে স্ট্যানটন আবার তাঁর পদ ফিরে পেয়েছিলেন। আর এর পর থেকেই গ্রান্টের শত্রু হয়ে যান জনসন। মজার ব্যাপার হল, জনসনকে অভিশংসন করার পদক্ষেপও নিয়েছিল সেই সময়ের মার্কিন কংগ্রেস। আর তা আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থনও করেছিলেন উলিসিস এস গ্রান্ট। অ্যান্ড্রু জনসন অবশ্য সে পর্যায়ে অভিশংসিত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। তবে গ্রান্ট প্রতিশোধ নিয়েছিলেন একই গাড়িতে সহযাত্রী না করে!
আমেরিকার ৩৭তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন নিকসন। তিনি আরও বিখ্যাত হয়েছিলেন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির জন্য।আর সেই খ্যাতির কারণেই আমেরিকার প্রথম ও একমাত্র প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। নিশ্চিতভাবে অভিশংসিত হওয়ার আগেই তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। মাঝপথে তাঁর পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড। তিনি যখন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিচ্ছিলেন, তার আগেই হোয়াইট হাউস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন রিচার্ড নিক্সন। নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠানে তিনিও অনুপস্থিত ছিলেন।