তিনি কখন কী করেন আর কখন কী বলেন জানা বোঝা মুশকিল- এতদিন ট্র্যাম্প সম্পর্কে এই ধারণাই করত আন্তর্জাতিক দুনিয়া। যে মানুষটি মাত্র একদিন আগে আমেরিকার পার্লামেন্ট ভবনে হামলা চালানোর প্ররোচনা দিয়েছেন, সমর্থকদের ‘দেশপ্রেমিক’ বলছিলেন, এখন তারাই হয়ে গেলেন ‘জঘন্য আক্রমণকারী’। আরও অবাক হতে হয়, গত দু’মাস ধরে যে ট্রাম্প নির্বাচনের ফলাফল সমানে অস্বীকার করে এসেছেন, এখন সেই তিনিই বলছেন, তার একমাত্র লক্ষ্য শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
তবে তিনি যে বাধ্য হয়েই ভোল পালটেছেন সে ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই। ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পকে মানসিকভাবে অসুস্থ উল্লেখ করে এখনই গদিছাড়া করে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। এমনকি এ বিষয়ে খোদ ট্রাম্পের মন্ত্রিসভাতেই আলোচনা হয়েছে। চারদিক থেকে চাপে পড়ে গিয়েছেন ট্র্যাম্প। তাই শেষমেষ পুরোপুরি তাঁর নিজের সুর পুরোপুরি বদলে ফেলেছেন। ১২ ঘণ্টা লক থাকার পর টুইটার অ্যাকাউন্ট ফিরে পেতেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ফের সরব হন। তবে নতুন ভিডিওতে তিনি যা বলেছেন, যেভাবে বলেছেন, তা আশা করেননি অনেকেই।
আমেরিকার ইতিহাসে এর আগে কোনও নির্বাচন এত ঘটনাবহুল ছিল না। প্রায় প্রত্যেক প্রার্থী পরাজয়ের পর হাসিমুখেই বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু ট্রাম্পই একমাত্র যিনি সব রকম সৌজন্যতার বাইরে থেকেছেন, কোনও কিছুই তিনি মানেন নি। শুধু তাই নয় ট্র্যাম্পের প্ররোচনাতেই আমেরিকার সাম্প্রতিক ইতিহাসে নির্বাচন ঘিরে এই প্রথম হিংসার ঘটনা ঘটল। একমাত্র ট্রাম্পের একরোখা মনোভাবের জন্যই আমেরিকার গণতন্ত্র, নির্বাচন ব্যবস্থা এইভাবে কালিমালিপ্ত হল—যা কল্পনার অতীত।
করোনাকালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর যখন ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন শেষপর্যন্ত হোয়াইট হাউস দখল করে নেন তখনও ট্রাম্প কিছুতেই হার মানতে রাজি নন। হোয়াইট হাউস ছাড়তেও তিনি রীতিমতো শর্ত চাপিয়ে দেন। তবে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার পর দুনিয়া জুড়ে ট্রাম্প সমালোচনার ঝড় যেভাবে বইতে শুরু করে তাতে ট্রাম্প ক্রমেই একা হয়ে পড়েন। একের পর এক মানুষ তাঁর প্রশাসন ছাড়তে শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে মন্ত্রীরাও আছেন। ট্রাম্পের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন তাঁর শিক্ষামন্ত্রী, পরিবহনমন্ত্রী থেকে শুরু করে ট্রাম্পের উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতো বিশিষ্টরা।
ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আরও ১২ দিন ক্ষমতায় থাকার সুযোগ থাকলেও ট্রাম্পকে সেই সময়টাও দিতে চায় না আমেরিকা প্রশাসন। কেবল তাই নয়, তার নিজের দল রিপাবলিকানও চায় না তিনি আর একদিনের জন্য ক্ষমতায় থাকুন। তার বিরুদ্ধে জোরালো হয়ে উঠেছে অভিশংসনের দাবি। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামতে হয় স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই। অবস্থা যে বেগতিক তা তিনি সামান্য দেরিতে হলেও বুঝে ফেলেন আর সঙ্গে সঙ্গে ভোল পাল্টে ফেলেন। একদিন আগে যে বিক্ষোভকারীদের দেশপ্রেমিক বলেছিলেন, আবেগে ভালবাসা জানিয়েছিলেন, সেখান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে নিজের বক্তব্য পাল্টে ফেলে তাদেরই এক হাত নিলেন। ভিডিও প্রকাশ করে ক্যাপিটলে তার সমর্থকদের তাণ্ডবকে ধিক্কার জানালেন, নিন্দা করলেন।
আড়াই মিনিটের বেশি সময়ের ভিডিওতে ট্রাম্প আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘আমার এখন লক্ষ্য সহজভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। ২০ জানুয়ারি নতুন প্রশাসন কাজ শুরু করবে। তার আগে আমি সব বুঝিয়ে দিতে চাই’। একে কই ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়-ভোজবাজি? ক্যাপিটলে ঢুকে তাণ্ডব চালানো নিজের দেশপ্রেমিক সমর্থকদের ২৪ ঘন্টা পেরনোর আগেই বানিয়ে দিলেন বিক্ষোভকারী। বললেন, ‘যেসব বিক্ষোভকারী ক্যাপিটলে অনুপ্রবেশ করেছেন তারা আমেরিকার গণতন্ত্রে আঘাত হেনেছেন। যারা এই হিংসা, ভাঙচুর ইত্যাদি কাজের সঙ্গে জড়িত তারা আমেরিকার প্রতিনিধি নন। যারা আইন ভেঙেছেন, তাদের দাম চোকাতে হবে’। ট্রাম্প যে নিজের ক্রীতকর্মের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত তা মোটেই নয়, তার সমর্থকদের কাজের সমলোচনাও তিনি যে করছেন না, তাও জলের মতো স্পষ্ট। তিনি চাপে পর্যুদস্ত, সম্পূর্ণত একা, নিঃসঙ্গ। আজ তার পাশে কেউ নেই। সেই চাপের ছে তিনি মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছেন। সুযোগ পেলেই তিনি শত্রুতা শুরু করে দেবেন, পিছন থেকে ছুরি মারবেন।
তিনি যে ক্যাপিটল বিল্ডিংকে সুরক্ষিত রাখতে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেছেন সেই ঘটনা ঘটিয়ছেন তিনি নিজেই। সেই ঘটনার জন্য আমেরিকা সহ প্রায় গোটা দুনিয়া ট্রাম্পকে দায়ী করেছে। অন্তত চার জনের মৃত্যু হয়েছে ওই ঘটনায়। ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় নিযুক্ত আমেরিকার অ্যাটর্নি জেনারেল মাইকেল শেরউইন ক্যাপিটল হামলার ঘটনায় ১৫টি মামলা দায়ের করেছেন। তার প্রশাসন থেকে ইস্তফা দিয়েছেন একের পর এক অফিসার। তার পরেই পরিস্থিতি সামাল দিতে ট্রাম্প শান্তির কথা উচ্চারণ করেছেন। আসলে তিনি বাধ্য হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, মার্কিন সংসদের ২৫তম সংশোধনী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওই সংশোধনী অনুযায়ী কোনও প্রেসিডেন্ট ‘দায়িত্ব পালনে অক্ষম’ হলে মেয়াদ শেষের আগেই তাকে সরিয়ে দেওয়া যায়। তবে তার জন্য ভাইস প্রেসিডেনন্টের নেতৃত্বে ভোটাভুটি প্রয়োজন হয়। জো বাইডেনের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পক্ষ থেকেও একই দাবি তুলে ধরা হয়েছে। তারা বলছেন, ২৫তম সংশোধনী প্রয়োগ করে ট্রাম্পকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। ডেমোক্র্যাট সিনেটররা কংগ্রেসর আইন বিষয়ক কমিটি ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সকে চিঠি পাঠিয়ে ট্রাম্পকে সরাতে পদক্ষেপ করতে বলেছেন। চিঠিতে তারা লিখেছেন, হামলা চালিয়ে ‘গণতন্ত্রের অবমাননা’ করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রসাশনিক এইসব প্রক্রিয়ার বাইরেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি হয়েছে। সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশও ট্রাম্পের উপর ক্ষুব্ধ। তাতে সামিল অনেক জনপ্রতিনিধিও। এই সব দেখেশুনেই ট্রাম্প ভয় পেয়েছেন, তাই তার গলায় শান্তির সুর।