উত্তম দত্তঃ বুধবার সিঙ্গুর ও কামারপুকুরে নির্বাচনী জনসভা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে অনেকটাই পাল্টেছে সিঙ্গুরের রাজনৈতিক সমীকরণ। একদা তৃণমূলের শক্তিঘাটি সিঙ্গুরে লোকসভা নির্বাচনে অনেকটাই শক্তি বাড়িয়েছে বিজেপি। ২০২১-এর আগে টিকিট না দল ছেড়েছেন সিঙ্গুরের 'মাস্টার মশাই'। বর্তমানে তিনি বিজেপির প্রার্থী। সিঙ্গুরের সভা থেকে নিজের হারানো ভোট ব্যাঙ্ক উদ্ধারের চেষ্টা থেকে সিঙ্গুর থেকে তার ভোটে লড়াই করার ইচ্ছের ছিল বলেও জানান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিনের সভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, আপনারা জানেন যে সিপিএম সমস্ত শক্তি দিয়ে সিঙ্গুরটা দখল করতে চেয়েছিল।আজকে আমার লজ্জা লাগে যারা সেদিন সিঙ্গুরে সবচেয়ে বেশি অত্যাচার করেছিল,নন্দীগ্রামেও তাই। সেইসব সিপিএমের হার্মাদরা আজকে সব বিজেপির বড় বড় ওস্তাদ হয়ে গেছে। আমি ভেবে পাই না,হঠাৎ কেন বিজেপির হয়ে লড়াইয়ে নামলেন মাস্টারমশাই? মাস্টারমশাইকে আমি সন্মান জানাই। তার বয়সটাকে আমি সন্মান জানাই। আমি তো তাকে দু'বার জিতিয়েছি। আমি নিজে বলেছিলাম মাস্টারমশাই যেহেতু আপনি আমাদের সকলের চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ,আপনি আমাদের অ্যাডভাইস করুন। আপনাকে আমাদের কোন একটি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান করে দেব। সেখান থেকে আপনি আপনার সন্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারবেন।
একইসঙ্গে সিঙ্গুরের তৃণমূল প্রার্থী বেচারাম মান্নার প্রশংসাও করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেন, আগামী পাঁচ বছরের জন্য বেচাকে এখানে কাজ করতে দিন। বেচা এখানকার লোকাল ছেলে। হরিপালে ছিল তাই এখানে দাঁড় করিয়েছি। মাস্টারমশাই তো আমাদের সঙ্গে নেই। তাই তার সম্বন্ধে আমার কিছু বলার নেই। বুধবার সিঙ্গুরের রতনপুরের জনসভায় তৃণমূল নেত্রী সুকৌশলে সিপিএম,বিজেপি ও মাস্টারমশাইকে এক ছাতারতলায় দাঁড় করিয়ে কটাক্ষ করলেন। এদিন তিনি বেচারাম মান্না,অসীমা পাত্র ও করবী মান্নার সমর্থনে সভা করেন।মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চ থেকে রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তথা মাস্টারমশাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,মাস্টারমশাই আপনি বাড়িতে থেকে সন্মান বাঁচান। আপনি ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন। সুস্থ জীবন কামনা করছি। সেই সঙ্গে তিনি বেচারাম মান্নাকে জেতানোর জন্য আশীর্বাদ করতে বলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরও বলেন,আপনারা জানেন, বেচা একথা নিশ্চয় জানে,আমি বাজে কথা কম বলি। আমি নন্দীগ্রামে দাঁড়িয়েছি। পাঁচ বছর আগে আমার সিঙ্গুরে দাঁড়ানোর ইচ্ছা ছিল। তার কারন হল,দুটি আন্দোলনের জায়গা হল এগুলি। আমি বেচাকে বললাম বেচা,মাস্টারমশাইকে বোঝা না, যদি মাস্টারমশাই এখান থেকে না দাঁড়ায়। অন্য কোথাও থেকে দাঁড়াক। তাহলে আমি সিঙ্গুর থেকে দাঁড়াই। বেচা বলল,মাস্টারমশাই শুনবেন না। আমি বললাম,ঠিক আছে। নো প্রবলেম। সিঙ্গুরে আমার দাঁড়ানোর ইচ্ছা ছিল। চেষ্টাও করেছিলাম। মমতা বলেন,তিনি সিঙ্গুর আন্দোলনে জন্য ২৬ দিন অনশন করেছি। আমি বিডিও অফিসে মার খেয়েছি।আমার সাথে আপনারাও মার খেয়েছেন। সেই মার খেয়ে আমার বুকে রক্তক্ষরণ হয়েছিল। মনে আছে পুজোর সময় ২৫ সেপ্টেম্বর বিডিও অফিসে মারপিট হয়েছিল।তারপর আমি হাসপাতালে ছিলাম।সরস্বতী দেবী,মহাদেব, কই আমার মাতঙ্গিনী হাজরা এসেছেন।তাদের কাছে ডেকে নেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পায়েলের খোঁজ করেন মমতা। পায়েল কত বড় হয়ে গেছে। মমতা বলেন,সিঙ্গুরে জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে অত্যাচার হয়েছিল তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আমি জয়ী হয়েছিলাম। কালা কৃষি কানুন বিল গরমেন্ট বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল।সিঙ্গুরের মানুষের জয় হয়েছিল। নন্দীগ্রামের মানুষের জয় হয়েছিল।সিঙ্গুরের আন্দোলনের পরই নন্দীগ্রামের আন্দোলন।মনে রাখবেন,কৃষি জমি আন্দোলনের প্রাণ কেন্দ্র সিঙ্গুর।সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম।আমাদের সকলের সারা জীবনের একটা সংগ্রাম।
এছাড়াও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সিঙ্গুরে আমরা অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দিব বলেছিলাম।দিয়েছি।আমরা কথা রেখেছি।১৬ কেজি করে চাল এখনও দেওয়া হয়।জমি ফিরিয়ে দিয়েছি।এখনো মাসে দু'হাজার টাকা করে কৃষকদের দেওয়া হয়।আমি বন্ধ করিনি।কৃষকদের উদ্দেশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,জমির জরিপ নিয়ে কিছু গন্ডগোল ছিল।সেগুলি মেটানো হয়েছে।এখানে হাসপাতালে ট্রমা কেয়ার ইউনিট হয়েছে। কৃষাণ মান্ডি হয়েছে।ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান হয়েছে।ডায়গোনেস্টিক সেন্টার হয়েছে।এখানে ১১ একর সরকারি জমি বেছে রাখা হয়েছে। ওখানে স্মলস্কেল ইন্ডাস্ট্রি হবে।এক একজনকে দশটা করে প্লট দেব। তারা তাদের মতো এগ্রো-ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলবে।
পাশাপাশি এদিন তিনি গোঘাটের কামারপুকুরেও জনসভা করেন। নন্দীগ্রামে মঙ্গলবার প্রচার শেষে বিজেপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কমিশনে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ জানায়। তার জবাবে গোঘাটের সভা থেকে মমতা বলেন,আমি সব বহিরাগত গুন্ডাদের ভিডিও রেখেছি।ইলেকশনটা মিটে যাক,তারপর দেখব কত ধানে কত চাল। দেখব,কোন গদ্দার তোমাদের কত শেল্টার দিতে পারে।কোথায় যাবে,দিল্লি,বিহার না উত্তরপ্রদেশ।যেখানেই যাওনা কেন রবীন মান্নাকে খুন করে ছাড়া পাবে না। যেখানেই থাকো না কেন কান ধরে নিয়ে আসব। আরো অনেক কেস আছে খুঁড়ে বের করবো।করিনি ভদ্রতা করে। অত বেশি বাড়াবাড়ি করতে যেও না। নন্দীগ্রামে ভোট হলে ১০০ জনের মধ্যে ১০০ জনই আমাকেই ভোট দেবে।সেই জন্যই ভয় দেখাচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালোই বুঝতে পারছেন এবার তার সামনে কঠিন লড়াই। তাই পুরোনো দিনের স্মৃতি উস্কে ভোট ব্যাঙ্কে তার প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছেন। সেই কাজে কতটা সফল বলেন তৃণমূল সুপ্রিমো তার উত্তর মিলবে ২ মে।