শমিকা মাইতিঃ বাংলার ভোটে হাইভোল্টেজ আসন একটাই- নন্দীগ্রাম। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই আসন থেকে লড়ছেন পূর্ব মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র শুভেন্দু অধিকারীর বিরুদ্ধে, যিনি সদ্য তাঁর সঙ্গ ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। শুভেন্দু প্রকাশ্যেই মেনে নিচ্ছেন এই ভোটের ফল তাঁর ‘কেরিয়ার’ ঠিক করে দেবে। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীকে হারাতে পারলে জেলার দাপুটে নেতা থেকে রাজ্যের অবিসংবাদী জয়ী নেতার তকমা পাবেন শুভেন্দু। কিন্তু তিনি হারলে খেলাটা আর মমতা বনাম শুভেন্দু থাকবে না। খেলাটা তখন সেই মোদী ভার্সেস মমতা- ২০২৪ এর লোকসভা ভোটের ‘পাওয়ার-প্লে’ কার হাতে থাকবে, সেই দিকে চলে যাবে। কারণ, তৃণমূল আর মমতা সমার্থক। মমতার হার মানেই তৃণমূলের হার। নন্দীগ্রামে মমতার জয় মানে বাংলায় তৃণমূলের জয়। তৃণমূলের জয় মানে বিজেপির হার। বিজেপির হার মানে মোদীর হার। ২০২১-এর ভোটে বাংলায় তৃণমূল জিততে পারলে, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে মোদীর বিরুদ্ধে মমতার নেতৃত্ব মাথা পেতে নেবে দেশের সমস্ত বিরোধী দল। তাই নন্দীগ্রামে ভোটের ফলের দিকে শুধু বাংলা নয়, তাকিয়ে রয়েছে পুরো দেশ।
শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর গত ১৮ জানুয়ারি নন্দীগ্রামের তেখালির মাঠে সভা করতে গিয়ে সেখান থেকে দাঁড়ানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন মমতা। নিজের এত দিনের কেন্দ্র ভবানীপুরকে ‘বড়বোন’ আর নন্দীগ্রামকে ‘মেজোবোন’ বলে উল্লেখ করেন। মমতার এই ঘোষণার পর গত বার এই আসনের জয়ী প্রার্থী শুভেন্দুর পিছু হঠার কোনও জায়গা ছিল না। তিনি পিছু হঠেনওনি। বরং মমতার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘সাহস থাকলে মাননীয়া শুধুমাত্র নন্দীগ্রাম থেকে লড়ে দেখান।’ মমতা সেই চ্যালেঞ্জও গ্রহণ করেছেন। এতদিনের জেতা আসন ভবানীপুর সহকর্মী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে ছেড়ে এবার শুধুমাত্র নন্দীগ্রাম থেকেই ভোটে লড়ছেন তিনি।
মমতা না শুভেন্দু- কে জিতবেন নন্দীগ্রামে?
একে-একে দুইয়ের অঙ্ক নয় এটা। নন্দীগ্রামে জমি আন্দোলনের কৃতিত্ব কারও একার নয়। নন্দীগ্রাম যেমন শুভেন্দুর কেরিয়ার তৈরি করে দিয়েছে, তেমন এটাও সত্যি, তরুণ এই নেতা মাটি কামড়ে থেকে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তৃণমূলের সংগঠন শক্তিশালী করেছেন। দু’পক্ষই একে-অন্যের পরিপূরক ছিল এতদিন। সেই সমীকরণটা ঘেঁটে যাওয়ায় সাংগঠনিক জোর দিয়ে হিসাব করা যাবে না এই আসনের ভোট। বরং মানুষের আবেগকে কে-কতটা ছুঁতে পারছেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক দিয়ে মমতা ‘অ্যাডভান্টেজে’ চলে গিয়েছেন ইতিমধ্যে। ১০ মার্চ নন্দীগ্রামের বিরুলিয়া বাজারে একটি মন্দির থেকে বেরনোর সময় পড়ে গিয়ে পায়ে চোট পেয়েছিলেন মমতা। প্রথমে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, চক্রান্ত করে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। পরে অবশ্য হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যে ভিডিও বার্তা মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছিলেন, তাতে ধাক্কা মারার কথা বলেননি। বরং বলেছেন, ‘গাড়ির বনেটের উপরে দাঁড়িয়ে আমি নমস্কার করছিলাম। এমন জোরে চাপ আসে যে পুরো গাড়িটা চেপে যায় আমার পায়ের উপরে।’ পায়ের প্লাস্টার খুলে হুইলচেয়ারে বসে এখন সারা রাজ্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন মমতা। সেই ‘সিমপ্যাথি-ভোট’ কিছুটা হলেও তাঁর দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরা। তবে, শুভেন্দুও গোটা ঘটনাকে নাটক আখ্যা দিয়ে পাল্টা প্রচার করছেন। ১৯ মার্চ শুক্রবার নন্দীগ্রামে প্রচারে গিয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘উনি পা দেখিয়ে ভোট চাইছেন। গোটা বাংলায় প্রার্থীরা হাতজোড় করে নমস্কার করে ভোট চাইছেন। আর উনি পা দেখাচ্ছেন।’ আবেগ আর সংগঠন চলে যাওয়ার পর হাতে পড়ে থাকে ধর্মের তাস। সেখানে হিসাবটা কেমন?
নন্দীগ্রামে ২.০৭ লক্ষ ভোটের মধ্যে ১.৩৭ লক্ষ (৬৬ শতাংশ) ভোটার হিন্দু, মুসলিম ভোটার রয়েছেন ৭০ হাজারের মতো (৩৪ শতাংশ)। বিজেপি-র হিন্দুত্বের রাজনীতির কারণে এই ৩৪ শতাংশ ভোট মমতার পক্ষে যাবে বলে ধরে নেওয়া যায়, যদি না তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ সেখান থেকে বড় একটা অংশ কেটে নেয়। প্রসঙ্গত, হটস্পট নন্দীগ্রামে সিপিএম প্রার্থী করেছে যুবনেত্রী মীনাক্ষি মুখোপাধ্যায়কে। তিনি কুলটির মেয়ে। প্রথমে ঠিক ছিল সংযুক্ত মোর্চার শরিক হিসাবে আব্বাস সিদ্দিকি-র দল আইএসএফ নন্দীগ্রামে প্রার্থী দেবে। রাজনীতির কারবারিদের মতে, সেক্ষেত্রে আইএসএফ-এর সংখ্যালঘু প্রার্থী যতটা মুসলিম ভোট কাটতে পারতেন, সিপিএমের যুবনেত্রী ততটা পারবেন না। এক্ষেত্রে তলে-তলে বিজেপিতে আটকাতে একটা ‘চক্রান্ত' হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। যদিও বামেরা সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। এই অবস্থায় মুসলিম ভোট কে-কতটা কাটবে সেটা বোঝাও কঠিন হয়ে গিয়েছে। বিজেপি-র হিসাব, শুভেন্দুকে ৬৬ শতাংশ হিন্দু ভোটের অন্ততপক্ষে তিনের চার ভাগ নিজের পক্ষে টানতে হবে। বড় টার্গেট। তবে, শুভেন্দুও জেলার ছেলে। নন্দীগ্রামের কোণা কোণা চষে বেড়িয়েছেন এতদিন। শুভেন্দুর বিশ্বাস, ‘উনি (মমতা) অপরাজেয় নন। উনি হারবেন।’