হবিবপুরে কেন বিজেপির দিকে পাল্লা ক্রমশ ঝুঁকছে, একটি অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদন

  • সরলা মুর্মুর দল বদল নিয়ে প্রভূত আলোচনা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে
  •  তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় নাম ছিল সরলার
  • নাম প্রকাশের পর জানিয়ে দেন, তিনি দলে থাকবেন না
  • কয়েকদিন পরেই সরলা বিজেপিতে যোগ দেন

তাপস দাস: সরলা মুর্মুর দল বদল নিয়ে প্রভূত আলোচনা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে। তৃণমূলের প্রার্থী তালিকায় নাম ছিল সরলার। তিনি নাম প্রকাশের পর জানিয়ে দেন, তিনি দলে থাকবেন না। কয়েকদিন পরেই সরলা বিজেপিতে যোগ দেন। পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সরলা বলেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসকে ভোট দেবার মতই কেউ নেই এই বিধানসভা ক্ষেত্রে। সরলার এই বক্তব্য হবিবপুর নিয়ে কৌতূহল ও আগ্রহের সৃষ্টি করেছে।

 মালদা জেলার হবিবপুর বিধানসভা ক্ষেত্রটির ছবি একবার দেখে নেওয়া যাক। হবিবপুর আসনটি মালদহ উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত। এই বিধানসভাটি তফশিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত। এই বিধানসভা আসনের মধ্যে পড়ে হবিবপুর ও বামনগোলা সমষ্টি উন্নয়ন ব্লক এবং আকতাইল, বৈদ্যপুর, বুলবুল চান্ডিল, ধুনপুর, হবিবপুর, জাজাইল, কানতুরকা, ও মঙ্গলপুর পঞ্চায়েত। বামনগোলা ব্লকের ২০ শতাংশের বেশি ও হবিবপুর ব্লকের ৩০ শতাংশ অধিবাসীই জনজাতি। দুই ব্লকের জনসংখ্যারই ৫০ শতাংশ তফশিলি জাতিভুক্ত। 

Latest Videos

এই কেন্দ্রটি ১৯৭৭ সাল থেকে সিপিএমের হাতে ছিল। এমনকী রাজ্যে বাম সরকারের পতন ঘটলেও হবিবপুরে সিপিএমের রাজপাট ছিল অক্ষতই। ২০০৬, ২০১১ ও ২০১৬ সালে হবিবপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন সিপিএমের খগেন মুর্মু। ২০১৯ সালের গোড়ায় তিনি দল বদলান। বিজেপিতে যোগ দেন সিপিএমের তিনবারের বিধায়ক। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তিনি বিজেপি প্রার্থী হিসেবে উত্তর মালদা কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়লাভ করেন। খগেন মুর্মু লোকসভা সাংসদ হবার পর হবিবপুর বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হয় ২০১৯ সালে। সেখানে জেতেন বিজেপি প্রার্থী জুয়েল মুর্মু। 

সিপিএমের থেকে জনজোয়ার বিজেপিতে কীভাবে ঘটল, তা বোঝার জন্য হবিবপুরের ইতিহাস-ভূগোল জানা প্রয়োজন। 

ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চল থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থিত এই মালদা এলাকায় আদিবাসী জনজাতিদের বাসের ইতিহাস রয়েছে। ব্রিটিশ শাসনের আমলে আদিবাসীদের উত্তরবঙ্গ ও আসামের চা বাগানের শ্রমিক হিসেবে নিয়ে যাওয়া হত। রংপুর প্রভৃতি এলাকা দিয়ে এই শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার ছড়িয়ে পড়তেন তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ, বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়। 

এখন যেসব আদিবাসী হবিবপুর এলাকায় রয়েছেন, তাঁদের পূর্বপুরুষরা এসেছিলেন অধুনা বাংলাদেশ থেকে। এঁরা সেখানে নির্মাণকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। নানাবিধ অত্যাচার না সইতে পেরে এঁদের অনেকেই ফিরে যান যে জায়গায় তাঁদের আদি বাস, সেই বর্তমান ঝাড়খণ্ডে। যাঁরা ফিরতে পারেননি, তাঁরা এখানেই থেকে যান। 

এই এলাকায় বসবাস শুরু করার পরে এই মানুষগুলি চাষের কাজ আরম্ভ করেন। উৎপাদিত ফলন হত মাঝারি পরিমাণের। কিন্তু ক্রমশ জলস্তর নিচে নেমে যাওয়া, ভূমিক্ষয়, সেচের অভাব, নিচের মাটিতে বালির পরিমাণ বৃদ্ধি, ইত্যাদি কারণে ফলনের পরিমাণ কমতেই থাকে। একই সঙ্গে উচ্চ ফলনশীল বীজ বা সার এঁদের আওতায় পৌঁছয়নি। 

সেচের বন্দোবস্ত না থাকায় এবং জলস্তর নেমে যাবার ফলে এঁদের কৃষিকাজ এখন পুরোটাই বর্ষার উপর নির্ভরশীল। খরিফ ছাড়া অন্য কোনও চাষ না থাকার ফলে বছরের অন্য সময়ে রোজগার থাকে না এলাকার চাষিদের। 

সিপিএম এই এলাকায় এতদিন রাজত্ব করার পরেও হাল ফেরেনি। স্বরাজ্যমার্গ পত্রিকার সঙ্গে কথা বলার সময়ে এলাকার প্রাক্তন সিপিএম কর্মী তথা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য সুকুমার মুর্মু জানান, এলাকায় সেচের খাল তৈরি হবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বামেরা, যাতে সারা বছর চাষের কাজ করা যায়। বলা হয়েছিল কৃষিঋণের ব্যবস্থা করা হবে যাতে কৃষি সামগ্রী, উচ্চ ফলনশীল বীজ ও সার কিনতে পারেন কৃষকরা। সুকুমার জানিয়েছেন, সেসব তো দূরের কথা, এর পরে সিপিএমের নেতারা মহাজনে পরিণত হলেন। তাঁরা অধিক সুদে ঋণ দেওয়া শুরু করলেন, যে ঋণের জেরে জমি বন্ধক রাখতে হল এলাকার মানুষদের। আর ঋণ শোধ করার জন্য অন্য রাজ্যে গিয়ে মজুরের কাজ শুরু করতে হল এলাকার চাষিদের। 

খগেন মুর্মু, যিনি সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে গিয়ে এখন উত্তর মালদা লোকসভার সাংসদ, তিনি স্বরাজ্যমার্গকে বলেছেন, কোনও উন্নয়নের কাজই এলাকায় হয়নি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যালয় স্থাপনের মত কর্মসূচিও থেকে গিয়েছে স্রেফ কাগজেই। খগেনের অভিযোগ, সিপিএমের নেতারা এলাকার মানুষের দুর্দশা দূর করার ব্যাপারে কখনওই গুরুত্ব দেননি। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতা দখলে রাখা এবং এলাকার মানুষের উপর জোর জুলুম চালানো। তিনি বলেন, “আমি এলাকার উন্নয়নের জন্য বহু চেষ্টা করেছি, কিন্তু প্রতিবারই আমাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে।” 

খগেনের কথার সমর্থন মিলবে সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবেই। বামনগোলা ব্লকের অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলির মাত্র ৪১ শতাংশ ও হবিবপুর ব্লকের গ্রামগুলির মাত্র ২৯ শতাংশ পাকা রাস্তার সঙ্গে যুক্ত। যদিও এলাকার বিজেপি বিধায়ক জুয়েল মুর্মুর কথায়, এর মধ্যেও বাড়াবাড়ি রয়েছে। খাতায় কলমে এরকম হিসেব দেখানো হলেও বাস্তবে এই পরিমাণ অনেকটাই কম। জুয়েল বলেছেন, মাত্র ৪০ শতাংশ গ্রামে নলবাহিত পানীয় জল পৌঁছিয়েছে এবং রাজ্য সরকার হবিবপুর এলাকায় এখনও কেন্দ্রীয় সরকারের জল জীবন (প্রতি বাড়িতে নলবাহিত পানীয় জল) প্রকল্প শুরুই করেনি। 

বামনগোলা ও হবিবপুর ব্লকের ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন বলে স্বরাজ্যমার্গের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে। ৫৫ শতাংশ মানুষ সাক্ষর নন। স্বচ্ছ ভারত মিশনের কাজ যথাযথ ভাবে না হওয়ার জন্য অধিকাংশ বাড়িতেই লাগোয়া শৌচাগার নেই। 

বামনগোলা ব্লকের ১ লক্ষ ৫৫ হাজার বাসিন্দা। এঁদের জন্য কোনও কলেজ নেই। প্রায় পরিকাঠামোহীন একটি মাত্র গ্রামীণ হাসপাতাল রয়েছে এখানে। আর রয়েছে দুটি মাত্র প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ব্লকের এক তৃতীয়াংশ এলাকায় কার্যকরী স্কুল নেই। 

হবিবপুর ব্লকের অবস্থাও তথৈবচ বলে জানাচ্ছে স্বরাজ্যমার্গের রিপোর্ট। এখানেও একটি গ্রামীণ হাসপাতাল আর দুটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এলাকায় স্নাতক মানের কোনও কলেজ নেই, যদিও একটি বি এড কলেজ ও একটি আইটিআই রয়েছে। 

৯-এর দশকে বিজেপির যাত্রা শুরু এই এলাকায়। ২০০১ সালে বিজেপি প্রথম এখানে বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী দাঁড় করায়। কয়েক হাজার ভোট গিয়েছিল পদ্ম চিহ্নে। ২০০৬ সালের ভোটে খগেন মুর্মু সিপিএমের হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে খুব সামান্য ব্যবধানে পরাজিত করেন বিজেপি প্রার্থী রামলাল হাঁসদাকে। রামলাল ৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ফল বেশ খারাপ হয়। কৃষ্ণচন্দ্র মুর্মু ২০ শতাংশ মত ভোট পান। ২০১৬ সালের নির্বাচনে বিজেপির প্রদীপ বাস্কে ২২.৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন। ২০১৯ সালের বিধানসভা উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী জুয়েল মুর্মু ৯২ হাজার ৩০০ ভোট পান, ভোট শেয়ার ছিল ৫০.৯৩ শতাংশ। 

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জুয়েল মুর্মু ফের জেতার অপেক্ষায়, সেটা একমাত্র বিষয় নয়। রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী পদ পেয়েও, সেখান থেকে বিজেপিতে চলে যাওয়া সরলা মুর্মুর আখ্যানই জানিয়ে দিচ্ছে হবিবপুরের পরিস্থিতি। 

Share this article
click me!

Latest Videos

পুলিশি অভিযানে বড়সড় সাফল্য! উত্তেজনা রানাঘাটে, দেখুন | Ranaghat News Today
আর ৮ মাস! জুলাই-অগাস্টে রাজ্যে অকাল ভোট হতে চলেছে! জানালেন BJP সাংসদ | BJP News | Samik Bhattacharya
TMC-কে ভোট দিলেই মিলছে ঠোঙা ভর্তি মুড়ি ও চানাচুর! শোরগোল মেদিনীপুরে | Midnapore | WB By election
অসাধ্য সাধন! যথেষ্ট পরিকাঠামো না থাকার সত্ত্বেও ৮০০ গ্রামের শিশুকে বড় করে তুলল বারাসাত মেডিক্যাল
'পুলিশ ও তৃণমূলের গুণ্ডারা সর্বত্র ভোট লুট করেছে' মারাত্মক অভিযোগ সুজন চক্রবর্তীর