রাতের অন্ধকারে এ যেন উঠ ছুড়ি তোর বিয়ে! রাতারাতি ধরে পাকড়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে নাবালিকাদের। ভাঙড়ের রাজাপুর গ্রামের এই নাবালিকা বিয়ের চক্রে নাম জড়িয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের। অভিযোগ এই নাবালিকা বিয়ের চক্রের পিছনে রয়েছে আরাবুল ২ ঘনিষ্ট কর্মী। পিকনিক করার ছলে লোকেদের চোখে ধূলো দিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে নাবালিকাদের।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের জন্য চালু করেছেন একাধিক সামাজিক প্রকল্প। যাতে মহিলারা সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। পড়াশোনা শিখে একটা স্তরে উঠতে পারে তার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগের শেষ নেই। অথচ, তাঁরই রাজ্যে তাঁরই দল তৃণমূল কংগ্রেসের দুই কর্মীর বিরুদ্ধে নাবালিকা বিয়ের চক্র চালানোর অভিযোগ সামনে এসেছে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা দক্ষিণ ২৪ পরগণার ভাঙড় থানা এলাকার রাজাপুর গ্রামে। অভিযোগ, সাদ্দাম মোল্লা এবং মোসলেম মোল্লার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ উঠেছে। দুজনেই ভাঙড়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আরাবুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ। ২ বছর ধরে সাদ্দাম এবং মোসলেম মোল্লা নামে এই যুবক এই নাবালিকা বিয়ের চক্র চালাচ্ছে বলে অভিযোগ।
স্বাতী ট্রাস্ট নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নাবালিকা বিয়ের এই চক্রের কথা সামনে আনে। এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অভিযোগ, একাধিকবার তারা চাইল্ড লাইনের হেল্পলাইন নম্বর ১০৯৮-এ সাহায্য চেয়েছিলেন। সেখানে কোনও সাড়া মেলেনি। এমনকী একাধিকবার ভাঙড় থানাকে এই নিয়ে সচেতন করা হলেও নাবালিকা বিয়ের চক্রকে ভাঙা যায়নি। সম্প্রতি এইভাবে রাতের অন্ধকারে চার থেকে পাঁচ জন নাবালিকার বিয়ে হয়ে যায় দালালদের মাধ্যমে। দালালরা অর্থের বিনিময়ে এই বিয়েগুলি দেয় বলে অভিযোগ। এই সব ঘটনার প্রেক্ষিতে ফের এই নাবালিকা বিয়ের চক্রকে ভাঙতে তারা উদ্যোগী হয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাতী ট্রাস্ট। এই বিষয়ে তারা ফের ভাঙড় থানা থেকে শুরু করে জেলা শিশু সুরক্ষা ইউনিত বা ডিসিপিইউ এবং জেলা শাসকের কাছেও অভিযোগ জমা করেছে। কিন্তু, তাঁদের অভিযোগ সেভাবে এখন পর্যন্ত নাবালিকাদের উদ্ধার করতে সেভাবে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা আরাবুল ইসলামের সঙ্গে দুই অভিযুক্ত, তাদের হাত থেকে পুষ্পস্তবক নিচ্ছেন আরাবুল
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগের আওতাধীন ডিসিপিইউ-এর সঙ্গে কথা বলা হয়েছিল। এই নাবালিকা বিয়ের চক্র নিয়ে তাদের কাছে অভিযোগ আসার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা তদন্ত করছেন বলেও জানিয়েছেন। ভাঙড় থানার কাছ থেকেও এই বিষয়ে রিপোর্ট চাওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু, ২ বছর ধরে একটি এলাকায় এই নাবালিকা বিয়ের চক্র চলছে আর ডিসিপিইউ-এর কাছে কোনও খবর নেই! এমন প্রশ্নের কোনও উত্তর মেলেনি। জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক জানিয়েছেন, যখন যখন তাঁদের কাছে অভিযোগ জমা পড়ে তারা খতিয়ে দেখেন এবং প্রয়োজনে নাবালিকাদের উদ্ধারও করেন। তাহলে রাজাপুর গ্রামের নাবালিকা বিয়ের চক্রকে কেন ভেঙে দেওয়া গেল না? এই অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার মতো শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগের কাউকেই পাওয়া যায়নি।
এই নাবালিকা বিয়ের চক্রের বিষয়ে ভাঙড় থানার আইসি সৈয়েদ রেজাউল করিমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি জানান, এই ধরনের খবর তারা পেলেই ব্যবস্থা নেন। এবারও নিচ্ছেন। ভাঙড় থানার দুটি দল রাজাপুর গ্রামে গিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলেও জানান তিনি। এই নাবালিকা বিয়ের চক্রের পিছনে কোনও মহিলা পাচারকারীদের হাত রয়েছে কি না তাও তাঁরা খতিয়ে দেখছেন বলে জানিয়েছেন। তবে, ২০ ফেব্রুয়ারি যে অভিযোগ দায়ের হয়েছে তাতে কেনও এখনও কোনও সুস্পষ্ট তথ্য সামনে এল না, এমন প্রশ্নের উত্তরে ভাঙড় থানার আইসি জানিয়েছেন, অনেক সময়ই পুলিশ দেখে নাবালিকাদের পরিবারের লোকজন লুকিয়ে পড়ে অথবা পুলিশের চোখে ধূলো দেওয়ার চেষ্টা হয়। এক্ষেত্রে তেমন কোনও ঘটনা ঘটেছিল কি না তদন্তে তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সন্দেহ নেই যে প্রশাসনের একটা বিশাল রকমের নিস্ক্রিয়তা গ্রামাঞ্চলে নাবালিকা বিয়ের এই চক্রগুলোকে মাথা চাড়া দিতে সাহায্য করছে। একটা এলাকায় শাসকদলের দুই কর্মী অবাধে নাবালিকা বিয়ের চক্র চালাচ্ছেন অথচ এলাকার পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজ্য শিশু অধিকার সুরক্ষা আয়োগের কর্মীদের কাছে তার কোনও তথ্য পর্যন্ত নেই। অথবা থাকলেও তারা বিষয়টিতে নিশ্চুপ।
দুই অভিযুক্ত সাদ্দাম মোল্লা এবং মোসেলেম মোল্লা, সাদ্দামের দাবি তারা জুতোর কারখানায় কাজ করে
জানা গিয়েছে, ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার বিনিময়ে সাদ্দাম মোল্লা এবং মোসলেম মোল্লার মতো লোকেরা নাবালিকাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। এই ক্ষেত্রে মূলত দুস্থ পরিবারের নাবালিকাদের নিশানা করা হচ্ছে। নাবালিকাদের বিয়ে যাতে কেউ ধরতে না পারে, তারজন্য নাকি গেট টুগেদার বা পিকনিকের মতো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাদ্দাম মোল্লা এবং মোসেলেম মোল্লার মতো লোকেরাই নাকি বিয়ের স্থান এবং কাল ঠিক করে। সেই অনুযায়ী সেখানে পাত্রপক্ষ সামান্য কিছু আড়ম্বর-সহ হাজির হয়ে যায়। মেয়ের বাড়ির লোকজনও মেয়ে নিয়ে হাজির হয়ে যায়। এবার সেই পিকনিকের আড়ালেই হয়ে যায় নাবালিকাদের বিয়ে। স্বাতী ট্রাস্টের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এদের বয়স ১৩ থেকে ১৭-র মধ্যে। গত ২ বছরে বিয়ে হয়ে যাওয়া এমন নাবালিকাদের মধ্যে অধিকাংশই এখন অন্তত এক সন্তানের জননী।
এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে অভিযুক্ত সাদ্দাম মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। তার দাবি, সে কলকাতায় জুতোর কারখানায় কাজ করতে সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রাত ১০টায় বাড়িতে ফেরে। তাঁদের কেউ ফাঁসানোর চেষ্টা করছে। এলাকার একজন মানুষ রয়েছে যে এই সব চক্রান্তের পিছনে জড়িত বলেও দাবি করে সে। এলাকার তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের সঙ্গে তাদের যে যোগাযোগ রয়েছে তা স্বীকার করে নেয় সাদ্দাম। বিষয়টি আরাবুল ইসলামকেও তারা জানাবে বলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। আর এক অভিযুক্ত মোসেলেম মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু, মোসেলেম বাড়ির বাইরে রয়েছে বলে তারা ফোন কেটে দেন।
রাজাপুর গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য মহম্মদ রেজাউল ইসলামের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। তিনি স্বীকার করে নেন যে গ্রামের মধ্যে এমন একটি চক্র কাজ করছে। যারা নাবালিকাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু, বিষয়টি নিয়ে এখনও তেমন কিছু তারা করে উঠতে পারেননি। গ্রামের যে দুই যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা যে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী স্থানীয় কর্মী তাও স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রভাবশালী হওয়াতেই কি নাবালিকা বিয়ের এই চক্রকে ভাঙা যাচ্ছে না? এমন প্রশ্নের কোনও উত্তর দেননি পঞ্চায়েত সদস্য রেজাউল।
শনিবার সন্ধ্যায় ভাঙড় থানার আইসি-র সঙ্গে ফের কথা বলা হয় এশিয়ানেট নিউজ বাংলার পক্ষ থেকে। তিনি জানান, অভিযুক্ত দুই যুবকের কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কি আপাতত ফেরার হয়েছে অভিযুক্তরা? এই নিয়ে এখনই তারা কিছু বলতে পারছে না বলে জানিয়েছেন আইসি। যে সব পরিবারের নাবালিকাদের বিয়ে হয়েছে বলে অভিযোগ সেই সব পরিবারের সঙ্গেও তারা কথা বলবেন জানিয়েছেন ভাঙড় থানার আইসি।
শুক্রবার জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্যে বলা হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গে ৪২ শতাংশ মহিলাই আইনমত ন্যূনতম বয়সে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে করে নিচ্ছে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গে নাবালক বিয়ের পরিসংখ্যানটা ২০ শতাং। মানে পুরুষরা আইনমত ন্যূনতম বয়সে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে করছে। পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের পরিসংখ্যানটা দ্বিগুণ। নাবালিকাদের বিয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পিছনে রয়েছে বিহার, ত্রিপুরা। অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই মহিলা কল্যাণে একাধিক উদ্যোগ নিতে শুরু করেছিলেন। সেই উদ্যোগ যে পশ্চিমবঙ্গের নাবালিকাদের পরিচয়কে আমূল বদলে দিয়েছে এমন দাবি এখনই করা যাচ্ছে না।