দুই বাংলার সীমান্ত বন্ধ হয়েছে বহু দিন আগেই। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আরও কড়াকড়ি হয়েছে সীমান্ত এলাকায়। কিন্তু, মানবিকতার কাছে হার মানল সব বাধাই। কাঁটাতারের বেড়াকে তুচ্ছ করে এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও শতবাধা অতিক্রম করে এপার বাংলা থেকে জীবনদায়ী ওষুধ পৌঁছে গেল ওপার বাংলার এক রোগীর কাছে। প্রতিদিনের মন খারাপ করা পরিস্থিতির মাঝে এমনই এক সুন্দর মুহূর্তের সাক্ষী থাকল হিলি সীমান্ত।
বাংলাদেশের নীলফামারির বাসিন্দা সালেহা খাতুন। অনেক দিন ধরেই হৃদরোগে আক্রান্ত তিনি। সাধারণত কলকাতায় এসে চিকিৎসক দেখান। গত ডিসেম্বরে চিকিৎসককে দেখিয়েছিলেন। ৬ মাস পর ফের কলকাতায় আসার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু, করোনা পরিস্থিতির জেরে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ভার্চুয়াল মাধ্যমে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওষুধ জেনে নিয়েছিলেন তাঁর ছেলে অধ্যাপক সৈকত সারোয়ার মোরশেদ। এই পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। এরপর মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে বেরিয়ে সমস্যায় পড়েন সৈকত। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে নীলফামারি ও ঢাকার কোথাও মায়ের চিকিৎসার জন্য তিনটি ওষুধ পাচ্ছিলেন না তিনি। হাল প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। অবশেষে খানিকটা নিরুপায় হয়ে তাঁর পরিচিত বালুরঘাটের বাসিন্দা পরিবেশ কর্মী তুহিনশুভ্র মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিজের সমস্যার কথা তুহিনবাবুকে জানান তিনি। এরপর করোনা পরিস্থিতির মধ্যে যেখানে রাজ্যে বিধিনিষেধ জারি রয়েছে সেই সবকিছুকে উপেক্ষা করে বন্ধুদের সাহায্যে মালদা ও বালুরঘাট থেকে তিনটি ওষুধ জোগাড় করেন তুহিনবাবু।
আরও পড়ুন- ২০ কিমি হেঁটে প্রিয় মাহুতকে শেষ সেলাম জানাল হাতি, দেখুন সেই ভাইরাল ভিডিও
তবে ওষুধ জোগাড় করলেও কাঁটাতারা পেরিয়ে তা 'ভাই' সৈকতের কাছে পৌঁছে দেওয়া অতটা সহজ ছিল না তুহিনবাবুর পক্ষে। এরপর বৃহস্পতিবার ওষুধ ও প্রেসক্রিপশন নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে হিলি সীমান্তে আসেন তুহিনবাবু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "প্রথমে বিষয়টা ইমিগ্রেশন অফিসারদের বোঝাতে হয়। ওষুধের গুরুত্ব বুঝতে পেরে তাঁরা রাজি হন। এরপর আর কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। ইমিগ্রেশন অফিসাররাই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বিএসএফ-এর সঙ্গে। এরপর বিএসএফ যোগাযোগ করেন বাংলাদেশের কাউন্টার পার্ট বিজিবির সঙ্গে। সব জায়গা থেকে সাড়া পাওয়ার পরই কাজটা খুব সহজ হয়ে যায়।"
এই প্রক্রিয়া চলাকালীন সীমান্ত এলাকায় এসে পৌঁছে গিয়েছিলেন সৈকতবাবু। যদিও আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে তুহিনবাবুর হাত থেকে সরাসরি ওষুধ নিতে পারেননি তিনি। বিএসএফ কর্তারা বিজিবির হাতে ওষুধের প্যাকেট তুলে দেন। সেখানে ইমিগ্রেশন হয়ে ওষুধ হাতে পান সৈকত। তারপর অবশ্য কাঁটাতারের বেড়ার দুই প্রান্ত থেকে ভিডিয়ো কলে দুই বন্ধুর মধ্যে কথা হয়। এভাবে এত তাড়াতাড়ি ওষুধ পেয়ে যাবেন ভাবতেই পারেননি সৈকতবাবু। ওষুধ হাতে পেয়ে সীমান্ত এলাকায় দাঁড়িয়েই তুহিনবাবুকে ভিডিয়ো কল করেন তিনি। এরপর সেই স্ক্রিনশট সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তিনি লেখেন, "দেশ ভাগ হল, ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট। দেশ মা যে ভাগ হয় না তা ৩ জুন আবার প্রমাণ করল তুহিনশুভ্র মণ্ডল দাদা।"
এই কঠিন পরিস্থিতিতেও ওপার বাংলার ভাইয়ের পাশে দাঁড়াতে পেরে আবেগঘন হয়ে পড়েছেন তুহিনবাবু। তিনি বলেন, "এই কঠিন পরিস্থিতিতে মানবিকতা বড় হয়ে গেল, সীমান্তের দরজা খুলে দুই বাংলা একে অন্যের পাশে দাঁড়াল। যেভাবে সবাই সাহায্য করেছেন তাকে আমি কৃতজ্ঞ।" ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার পরও সৈকতবাবুকে সাহায্য করে চলেছেন তুহিনবাবু। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "সৈকতের মা একটি মেশিন ব্যবহার করেন। বেঙ্গালুরুর এক চিকিৎসকের পরামর্শে সেই মেশিনটি ব্যবহার করছেন তিনি। ৬ মাস তাঁকে সেই মেশিন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন চিকিৎসক। ইতিমধ্যে ৬ মাস কেটে গিয়েছে। এরপরও সেই মেশিন ব্যবহার করতে হবে কি না সেই বিষয়টি জিজ্ঞাসা করার জন্য চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তাই এর জন্য ফের আমার সঙ্গে সৈকত যোগাযোগ করেছিল। আমার এক পরিচিত শীঘ্রই নিজের কাজে বেঙ্গালুরুতে যাবেন। তাঁকে ওই চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে বলেছি। প্রয়োজনে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে সৈকতের সঙ্গে তিনি চিকিৎসকের কথা বলিয়ে দেবেন।"