বন্ধুর হাতেই কি সর্বনাশ হলো জিয়াগঞ্জে সপরিবার খুন হওয়া স্কুল শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পালের? তদন্তে নেমে নিহত স্কুল শিক্ষকের বন্ধু শৌভিক বণিকের সম্পর্কে যে তথ্য পুলিশের হাতে এসেছে, তাতে এমনই সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা। পুলিশের হাতে আটক শৌভিক মহিলাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে যে অনেককেই প্রতারণার জালে জড়িয়েছে, তা জানার পরে ওই যুবকের উপরে সন্দেহ আরও বেড়েছে পুলিশের।
দশমীর দিন সপরিবারে জিয়াগঞ্জের লেবুবাগান এলাকায় অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, ছ' বছরের ছেলের সঙ্গে খুন হয়েছিলেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশ পাল। নৃশংস এই হ্ত্যাকাণ্ডের পিছনে রাজনৈতিক কারণ আছে কি না, তা নিয়েও জল্পনা তৈরি হয়। ঘটনার পরে পাঁচ দিন কেটে গেলেও রহস্যের কিনারা করতে ব্যর্থ পুলিশ। কিন্তু যে কয়েকজনকে এই হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত বলে সন্দেহ করছে পুলিশ, তাদের মধ্যে অন্যতম বীরভূমের রামপুরহাটের বাসিন্দা নিহত স্কুল শিক্ষকের বন্ধু শৌভিক বণিক। তাকে ইতিমধ্যে আটক করে জেরা শুরু করেছে পুলিশ।
তদন্তে পুলিশ আগেই জানতে পেরেছিল, ব্যবসায়িক কারণে নিজে ঋণ নিয়ে শৌভিককে প্রায় ছ' লক্ষ টাকা জোগা়ড় করে দিয়েছিলেন বন্ধুপ্রকাশবাবু। কিন্তু সেই টাকা ফেরত দেয়নি শৌভিক যা নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে বিবাদের সূত্রপাত। শৌভিকের সম্পর্কে খোঁজখবর করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে, অতীতে অনেকের সঙ্গেই প্রতারণা করেছে রামপুরহাটের বাসিন্দা শৌভিক বণিক। প্রতারণা করার জন্য বিভিন্ন মহিলাকে জালে ফাঁসাত সে। বন্ধুপ্রকাশবাবুর স্ত্রী বিউটিও সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন বলেও অনুমান তদন্তকারীদের।
শৌভিকের বাড়ি বীরভূমের রামপুরহাট পুরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের গ্যাস অফিস গলিতে। তার বাবা বিদ্যুৎ বণ্টন
নিগমের অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। দীর্ঘদিন থেকেই ছলেবলে মহিলাদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ব্যবসার নামে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কারবার চালাত শৌভিক। কেউ কেউ টাকা চাইতে গেলে হুমকির মুখেও পড়তে হত বলেও দাবি করেছেন প্রতারিতরা। তার এই প্রতারণার কথা পরিবারের অনেকেই জানত বলেও অভিযোগ।
,
পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পেরেছে, নিহত শিক্ষক পরিবারের সঙ্গে একইভাবে ভাব জমিয়েছিল শৌভিক। তার প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে মোটা অঙ্কের সুদে টাকা নিয়ে শৌভিককে দিয়েছিল শিক্ষক দম্পত্তি। এই থেকে তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত শুরু হয় শৌভিকের। তদন্তকারীদের অনুমান, বিউটির সঙ্গে সম্পর্কও গড়ে তুলতে শুরু করেছিল সে। এমন কী, বিভিন্ন ভাবে মোটা অঙ্কের টাকা আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিউটির নামে রামপুরহাট মহকুমার বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কে খাতা খুলিয়ে মোটা টাকা ঋণ নিয়েছিল শৌভিক। সেই টাকা পরিশোধ নিয়েই শুরু হয় অশান্তি।
শুধু ওই শিক্ষক দম্পতির কাছ থেকেই নয়, রামপুরহাট পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ডাক্তার পাড়ায় তিনটি পরিবারের কাছ থেকে একই ভাবে শৌভিক কয়েক লক্ষ টাকা ব্যবসার নামে নিয়েছিল সে। সেই টাকা পরিশোধ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও চলছে। প্রতারিত এক গৃহবধূ জানান, তাঁর কাছ থেকে কয়েকবারে প্রায় দশ লক্ষ টাকা নিয়েছিল শৌভিক। সে জানিয়েছিল, সাগরদিঘিতে জলের ফ্যাক্টরি করবে। অধিকাংশ টাকা নগদে দেওয়া হয়েছিল। কিছু টাকা চেকের মাধ্যমেও দেওয়া হয়। সেই টাকা চাইতে গেলে তার বাবাও ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলত বলেই অভিযোগ করেছেন প্রতারিত ওই গৃহবধূ। তাঁর আরও অভিযোগ, শৌভিকের সঙ্গে বেশ কয়েকজন সমাজবিরোধীর ওঠাবসা থাকায় টাকা আদায় করা সম্ভব হয়নি। ফলে, টাকা আদায় করতে রামপুরহাট থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। মামলা গড়ায় হাইকোর্টে।
মিষ্টিভাষী শৌভিককে দেখে কেউ তাকে প্রতারক বলে ভাববে না। ফলে, অনেকেই তার খপ্পরে পড়ে। এরকম বেশ কিছু তথ্য তদন্তকারী অফিসারদের হাতে এসেছে। তাই শৌভিকের খোঁজে শুক্রবার বিকেলে রামপুরহাটের বাড়িতে আসেন লালবাগ মহকুমা পুলিশ আধিকারিক বরুণ বৈদ্য। সেখানে তার খোঁজ না পেয়ে সন্ধ্যার দিকে সিউড়িতে জাতীয় সড়কের ধারে তার ভাড়া বাড়িতে যায় পুলিশ। কিন্তু পুলিশ তার বাড়িতে পৌঁছেছে খবর পেয়েই শৌভিক গা ঢাকা দেয়। দু' টি বাড়ি থেকেই পুলিশ বেশ কিছু কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়।
সূত্রের খবর, শুক্রবার রাতেই পুলিশ শৌভিককে আটক করে। অন্যদিকে শৌভিকের সঙ্গেই আটক করা হয়েছে নিহত শিক্ষকের বাবা অমর পালকে।