৩ মাসের বৃহস্পতির কাছে হার মেনেছে ঘূর্ণিঝড় আমফান, ফোটো তুলতে গেলেই তার যত লজ্জা

  • চলে গিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আমফান, কিন্তু রয়ে গিয়েছে তার ক্ষত
  • এই ধ্বংস মেরামতিতে কতদিন সময় লাগবে তা বলা মুশকিল
  • যে প্রবল গতিতে আমফান আছড়ে পড়েছে তাতে বলা সত্যি কঠিন 
  • তবে, এই ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে সামনে আসছে অসামান্য সব কাহিনি
     

বৃহস্পতি। বয়স মাত্র ৩ মাস। ঘূর্ণিঝড় আমফানের দিন একটি নির্মিয়মাণ ঘরের মধ্যেই মা লালি এবং আরও তিনটি ছাগলের সঙ্গে বাঁধা ছিল। কাকদ্বীপের লট নম্বর ৮ ঘাটের একদম নদীর তীরে বাড়ি সন্ধ্যা দাসের। সন্ধ্যা জানিয়েছেন, ২০ মে দুপুর থেকেই প্রবল ঝড়ৃ-বৃষ্টি হচ্ছিল আমফানের জন্য। চারিদিকে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বাতাসের তীব্রতা এতটাই ছিল যে মনে হচ্ছিল বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। আশাপাশের বাড়ি ও দোকানের টিনগুলি যেভাবে মর্মর করে উঠছিল তাতে সন্ধ্যার আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছিল। 

Latest Videos

এই পরিস্থিতির মধ্যে কয়েকজনের টিনের চাল উড়ে যায়। এমনকী উড়ে চলে যায় অ্যাস্বেস্টার্সের ছাদও। আবার অনেকের অ্যাস্বেস্টার্সের ছাদে অন্যের ছাউনি টিন এসে পড়েছিল। ঘর থেকে ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ করছিলেন সন্ধ্যা। দেখছিলেন কীভাবে প্রকৃতি তুর্কি-নাচন করাচ্ছে সকলকে। 

বিকেল ৫টা থেকে ঝড়ের অভিমুখ বদলে যায়। এবার দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ থেকে এসে ধাক্কা মারে অন্তত ১৮০ কিলোমিটার বেগের আমফান। সন্ধ্যা জানিয়েছেন, মনে হচ্ছিল সব শেষ হয়ে যাবে। আগের থেকে বাতাসের গতি কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছিল। তেমন-ই ঝড়ের তাণ্ডব। এমনই পরিস্থিতি সন্ধ্যার অসমাপ্ত দোতালার দেওয়াল ভেঙে পড়ে। এক্কেবারে নদীর পাশে হওয়ায় বাতাসের বেগ নিতে পারেনি দেওয়াল। তারপরে লিন্টন ঢালাই না থাকায় দেওয়ালগুলির মজবুত ছিল না। ফলে ১৮০ কিলোমিটার বেগের হাওয়ার হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে দেওয়াল। যে ছাদের উপরে এটি ভেঙে পড়ে তার ঠিক নিচের ঘরেই ছিল বৃহস্পতি ও তার মা লালি এবং তিনটি ছাগল। দেওয়ালের আচমকা ভেঙে পড়ার ধাক্কা সামলাতে পারেনি ছাদটিও। মুহূর্তের মধ্যে ছাদটিও ভেঙে পড়ে। আর এই ধ্বংসস্তূপ এসে সোজা বৃহস্পতির গায়ে। 

সন্ধ্যার কথায়, একে চারিদিকে অন্ধকার। তারমধ্যে ঝড়ের সেই প্রলঙ্কর তাণ্ডব। মনে হচ্ছিল যেন মূর্তিমান বিভীষিকা। এরই মধ্যে ছাদ ভেঙে পড়ার ঘটনা। অন্ধকারের মধ্যে কোনও মতে ধ্বংসস্তূপের সামনে আসেন। দরজার সামনে তখন তিনটি ছাগল এবং বৃহস্পতির মা লালি- তাদেরকে তাড়াতাড়ি বের করেন সন্ধ্যা এবং তাঁর ছেলে ও মেয়ে। এরপর ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনেন বৃহস্পতিকে। সন্ধ্যা ভেবেছিলেন হয়তো সব শেষ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু, বৃহস্পতিকে টেনে বের করার সময় তিনি বুঝতে পারেন ছাদের ভাঙা অংশ পুরোপুরি এসে পড়েনি। বৃহস্পতিবার গায়ে তা পড়ার আগে কোনওভাবে কোথাও আটকে গিয়েছে। 

সন্ধ্যা জানিয়েছেন, আতঙ্কে তখন কাঁপছে বৃহস্পতি। গলার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। কোলে করে নিয়েই বাড়ির ভিতরে ছুট মারেন সন্ধ্যা। ঝড়ের মধ্যেই বৃহস্পতিকে কোলে বসিয়ে সমানে তার হাত-পা মালিশ করতে থাকেন। এদিকে সন্তানের কিছু হয়েছে বুঝতে পেরে লালি তখন চিল-চিৎকার জুড়ে দিয়েছে। তার দেখাদেখি তিনিটি ছাগলও ডাকতে থাকে- যাদের নাম আবার কালি, বন্ধন ও খুঁড়ি। 

২০ মে রাত আর ঘুম আসেনি সন্ধ্যা ও তাঁর পরিবারের। কী ভয়ানক বিভীষিকা হয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আমফান তা এখনও ভেবে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। প্রায় গোটা রাত বৃহস্পতির শুশ্রূষা করে গিয়েছেন। গভীররাতে পরিস্থিতি শান্ত হলে বাইরে বেরিয়ে আসেন সন্ধ্যারা। চারিদিকে ত্রস্ত-বিধ্বস্ত চেহারাটা দেখে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে এটা লট নম্বর ৮-এর ঘাট। মনে হচ্ছিল কেউ যেন উপর থেকে হামানদিস্তা দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে সবকিছু। 

সকালের আলো ফুটলে ভেঙে পড়া ঘরে ঢোকেন সন্ধ্যারা। বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে একটা কংক্রিটের নির্মাণ এভাবে ভেঙে পড়তে পারে। ছাদের ধ্বংসের চেহারা দেখে তখন একমনে ঠাকুর-কে ধন্যবাদ জানিয়ে যাচ্ছিলেন সন্ধ্যা। কারণ, এমন এক ধ্বংসে বৃহস্পতি-র বেঁচে থাকাটা তাঁর কাছে তখন অলৌকিক বলেই মনে হচ্ছিল।  আর বৃহস্পতি তখন মা- লালি-র পরম আদরে ভরে যাচ্ছিল। 

এশিয়ানেট নিউজ বাংলার সঙ্গে সন্ধ্যা ও তাঁর পরিবারে আলাপ লট ৮ নম্বর ঘাটে। ঘোড়ামারা থেকে সাগরের পথে-র জন্য আমি এবং আমার সঙ্গী চিত্র সাংবাদিক অমিত ৩০ মে কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়েছিলাম। লট ৮ নম্বর-এ সন্ধ্যার বাড়িতে আমরা যখন আমাদের মোটরবাইকটা রেখে কয়েক সেকেন্ডে মিলিয়ে গিয়েছিলাম ট্রলারের খোঁজে তখনও জানতাম না সেই বাড়ির ছোট্ট বাছুরের বেঁচে যাওয়ার অলৌকিক কাহিনিটা। ৩১ মে বিকেলে যখন এশিয়ানেট নিউজ বাংলার আমরা দুই নিরুদ্দিষ্ট সাংবাদিক ফের হাজির হয়েছিলাাম সন্ধ্যার বাড়ির দরজায়, তখন আমাদের চোখে আসে ছাদের ভেঙে পড়ার ছবিটা। আলাপচারিতায় সামনে আসে বৃহস্পতির কাহিনি।  এরপর আমরা যখন বৃহস্পতির ছবি তোলার চেষ্টা করি তখন সে পরম কৌতুহল নিয়ে ক্যামেরার দিকে চোখ দেয়। পরক্ষণেই মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছনে। সন্ধ্যা হাসতে হাসতে জানালেন আসলে ও-এখন লজ্জা পাচ্ছে। আমারও হেসে ফেললাম।  সেখানেই আলাপ হয় আরও বেশকিছু মানুষের সঙ্গে। তাঁরাও জানান কারওর বাড়ির চাল উড়ে চলে গিয়েছে। কারওর আবার বাড়ির অ্যাস্বেস্টার্সের উপর এসে পড়েছে অন্যের ছাউনি। ঘূর্ণিঝড় আমফানের পরও লাগাতার বৃষ্টি হয়েছে। কালবৈশাখী এসেছে ৯৬ কিলোমিটার গতিবেগে। ফলে, ভেঙে পড়া চালের ঘর থেকে বেরিয়ে অনেকেই ঠাঁই নিয়েছেন আশাপাশের কারোর বাড়িতে। অনেকে আবার সরকারি সাহায্যের আশা না করেই নিজেরাই ছাদ মেরামতি করে নিয়েছেন। লট নম্বর ৮-এ দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিলাম আমরা ধ্বংসের যে ছবি ঘোড়ামারা বা গঙ্গাসাগরে দেখেছি, কাকদ্বীপের লট নম্বর ৮-এর ছবিটার তার থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয়। বুঝলাম ঘূর্ণিঝড় আমফান শুধু একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় নয় এমন একটা ভয়, যা হয়তো কাহিনির আকারে ইতিহাসের পাতায় থেকে যাবে। 

Share this article
click me!

Latest Videos

Live: মথুরাপুরে সদস্যতা অভিযান অগ্নিমিত্রা পালের, দেখুন সরাসরি
টাকা 'হজম' করার আগেই ধরে ফেলে খেলা ঘুরিয়ে দিলেন শুভেন্দু অধিকারী | Suvendu Adhikari | Awas Yojana
ভাটপাড়ায় প্রোমোটারের 'দাদাগিরি', আতঙ্কে জমির মালিক, কি বলছে পুরসভা! দেখুন | Bhatpara News
'আমি মারা গেলে আমার যেন স্ট্যাচু না হয়' দলের উদ্দেশ্যে বার্তা মমতার
‘সবরমতি রিপোর্ট’ দেখলেন বিজেপির হেভিওয়েটরা! দেখুন কী বার্তা দিলেন সিনেমার ব্যপারে | Sabarmati Report