জয়নগরে নাবালিকা ধর্ষণ-খুনের মামলায় এবার ফাঁসির নির্দেশ আদালতের।
বৃহস্পতিবার, এই মামলার মূল অভিযুক্ত মুস্তাকিন সর্দারকে দোষী সাব্যস্ত করেন বারুইপুরের ফাস্ট অ্যাডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট জাজেস কোর্টের বিচারক সুব্রত চট্টোপাধ্যায়। এরপর শুক্রবার, রায় ঘোষণা করলেন তিনি। পাশাপাশি মৃতার পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
মামলার রায়দানের পর সরকারি আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায় জানান, “নৃশংস ঘটনা, বিরল ঘটনা। তাই ফাঁসির আবেদন করেছিলাম আমরা। বিচারক দোষীকে ফাঁসির সাজাই দিয়েছেন। এই মামলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ডিএনএ প্রোফাইল মিলে গেছে। ফলে, সন্দেহের আর কোনও অবকাশই নেই।”
আরজি কর আন্দোলনের আবহে প্রকাশ্যে আসে জয়নগরের ঘটনা। জয়নগরে নির্যাতিতার বাড়িতে যান আরজি করের আন্দোলনকারীরাও। শুধু তাই নয়, ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের অনশনমঞ্চের সামনে নির্যাতিতা নাবালিকার প্রতীকী মূর্তিও রাখা হয়। ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’-এর সঙ্গেই ‘জাস্টিস ফর জয়নগর’ স্লোগানও উঠতে শুরু করে।
তবে জয়নগর কাণ্ডের ৬৩ দিনের মাথায় বিচার মিলল। জয়নগরের ঘটনায় দোষীর ফাঁসির সাজা হতেই এক্স হ্যান্ডলে রাজ্য পুলিশের তরফ থেকে একটি পোস্ট করা হয়। সেখানে লেখা হয়, “জাস্টিস ফর জয়নগর!’ এই রায় নজিরবিহীন। নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুনের মামলায় ঘটনার মাত্র ৬৩ দিনের মধ্যে অভিযুক্তের ফাঁসির আদেশ এর আগে পশ্চিমবঙ্গে কখনও ঘটেনি। এই মামলার তদন্তে আমাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, যত দ্রুত সম্ভব নির্যাতিতা এবং তার পরিবারকে ন্যায়বিচার দেওয়া। মেয়েটি আর ফিরবে না। কিন্ত যে অভূতপূর্ব দ্রুততায় তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে আমরা ‘জাস্টিস’এনে দিতে পেরেছি, দীর্ঘদিন বিচারহীন থাকতে হয়নি, এটুকুই আমাদের সান্ত্বনা, আমাদের প্রাপ্তি।”
গত ৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ হয়ে যায় সেই নাবালিকা। মেয়ে বাড়ি না ফেরায় খোঁজাখুঁজি শুরু করে দেন পরিবারের লোকজন। স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতেও খবর দেওয়া হয়। প্রাথমিকভাবে অবশ্য পুলিশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ ওঠে। এরপর গভীর রাতে বাড়ির কাছের জলাজমি থেকে উদ্ধার করা হয় মেয়েটির দেহ। আর সেই রাতেই গ্রেফতার হয় মুস্তাকিন। তবে পরদিন সকালে পুলিশ এবং স্থানীয় নেতারা এলাকায় গেলে, তাদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে।
এমনকি, হামলা চালানো হয় স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতেও। ঘটনার পরে প্রাথমিকভাবে খুনের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করে দিয়েছিল পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে পকসো ধারা যুক্ত করা হয় সেই মামলাতে। সেইসঙ্গে, এই ঘটনার দ্রুত তদন্ত করে শাস্তির আশ্বাস দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও। আর এরপরেই ঘটনার তদন্তে সিট গঠন করা হয়। ঘটনার প্রায় ২৬ দিন পর, ৩০ অক্টোবর চার্জশিট পেশ করে তদন্তকারী দল। এরপর গত ৫ নভেম্বর থেকে শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
মোট ৩৬ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল এই মামলায়। শুক্রবার সকালে উনিশ বছর বয়সী মুস্তাকিনের সাজার মেয়াদ নিয়ে শুনানি ছিল। সকাল ১১টা ৪৫ মিনিটে লকআপ থেকে আদালত কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় অপরাধীকে। এরপর দুপুর ১২.১৫ মিনিটে শুরু হয় শুনানি। দুপক্ষের আইনজীবী এবং দোষীর বক্তব্য শোনার পর রায়দান কিছুটা স্থগিত রাখেন বিচারক।
যদিও মুস্তাকিন জানান, তিনি নাবালিকাকে ধর্ষণ-খুন করেননি। তিনি বলেন, “আমি এই কাজ করিনি। বাবা-মায়ের এক সন্তান আমি। বাবা অসুস্থ। আর আমি ছাড়া ওদের দেখার কেউ নেই। যদি পারেন, আমাকে মাফ করে দেবেন।” মুস্তাকিনের আইনজীবীও বিচারককে বলেন, “বাবা অসুস্থ হওয়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে কাজ শুরু করেছিল মুস্তাকিন। নাবালক হওয়া সত্ত্বেও ওর বিরুদ্ধে এর আগে কোনও মামলা নেই। ও জড়িতও নয়। পরিবারের কথা বিবেচনা করবেন। ওর বয়স বিবেচনা করে ওকে শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিন।”
কিন্তু পাল্টা দোষীর ফাঁসির দাবি জানান সরকারি আইনজীবী। তাঁর বক্তব্য ছিল, মুস্তাকিনকে যে যে ধারায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে চারটি ধারায় সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি। এরপর কুড়ি বছর পর যদি অপরাধী বাইরে বেরিয়ে আসেন, তখন সমাজে কী প্রতিক্রিয়া হবে? সরকারি আইনজীবী বলেন, “মেয়েটি বিশ্বাস করে ওর সাইকেলে উঠেছিল। এরপর মেয়েটিকে নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে খুন করেছে ও। এটি পূর্বপরিকল্পিত একটি ঘটনা। মুখ টিপে এবং শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যু নিশ্চিত করতে শক্ত জমির উপর বারবার মাথা ঠুকে দেওয়া হয়েছে মেয়েটির। শরীরে ৩৮টি আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। নৃশংস ঘটনা এটি! একে ক্ষমা করা হলে ভবিষ্যতে আবার ঘটবে এই ধরনের ঘটনা।”
এছাড়া সরকারি আইনজীবীর বক্তব্যে আরজি করের নিহত মহিলা চিকিৎসকের প্রসঙ্গও উঠে এসেছিল। শেষপর্যন্ত, সরকার পক্ষের আইনজীবীর ফাঁসির আবেদনেই সাড়া দেন বিচারক।
আরও খবরের আপডেট পেতে চোখ রাখুন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে, ক্লিক করুন এখানে।